শত শতকে যত প্রাপ্তি!

চৌধুরী মোহাম্মদ ইমতিয়াজ »

শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। বাংলায় ১৪ কিংবা ইংরেজীতে গুনে গুনে ২১টি বর্ণমালায় গঠিত এই নাম যেটুকু লম্বা, তার চেয়েও কয়েক যোজন দীর্ঘ মানুষটির ইতিহাস। ক্রিকেট আকাশ পানে পলক পড়তেই জ্বলজ্বল করে যে তারারত্ন আঁখিতে ধরাতে দেয়, তাঁর মধ্যে সবচেয়ে আলোকিত তারার নাম এই, ভারতীয় ক্রিকেট তথা গোটা দুনিয়ার সেরা সেই। ব্যাটের যাদুকে কুপোকাত করেছেন বাঘা বাঘা সব বোলারদের মনোবল। ধুমড়ে মুচড়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষের ডেরা। জয় করেছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব।

‘আরে ধূর! অসময়ে (করোনাকাল) সুসময়ের কেচ্ছা।’ হঠাৎ শচীন বিলাপে এমনটাও বলে উঠতে পারেন কেউ কেউ। হ্যাঁ! আপনি ঠিকই ধরেছেন। করছি এমনই এক সুসময়ের বিলাপ, যেই বিলাপ পরবর্তী প্রজন্মের পথের আলো। সেই আলো একদিন ঘোর অমাবশ্যার রাতে জ্যোৎস্না হয়ে নামবে না তা কি বলা যায়? মোটেই না। কেনই বা নয়? মাত্র ১৬ বছর বয়সে আকাশী-নীলদের জার্সি গায়ে জড়ানো এক কিশোর, যে ক্রিকেট ইতিহাস লিখিয়েছেন নতুন করে, আলাদা পাতায়।

পাক্কা একশো শতক। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঊনপঞ্চাশ, সাদা পোশাকে একান্ন। দুই সংস্করন মিলিয়ে শতকের সেঞ্চুরী করেছেন। এমন কীর্তি গড়ার দ্বিতীয় নজীর এই গ্রহে আপাতত নেই। ভবিষ্যৎটা এখনো ক্রিকেট জ্যোতিষীর হাতে তোলা। ঘুরে ফিরে আসা যাক লিটল মাস্টার ব্লাস্টারের স্বর্ণালী রাজ্যে। যেখানে নাক শোকতেই পাওয়া যায় অজস্র জয়ের সুবাস। দৃশ্যমান সব অর্জনে ভরা ঝুলির সমাহার, দ্য ওয়াল্ড অব শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।

ছোটখাটো দেহের এই ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারের চুরাবালি কুড়িয়ে একত্র করতে গেলে একটি পরিপূর্ণ উপন্যাসে ঠাই নেবে, নিঃসন্দেহে। তবে এটুকুন মন কুনো করার সুযোগ নেই। আপনার জন্য থাকছে শচীনের শত শতকের প্রাপ্তির চুম্বকাংশ। ছানাভরা চোখে স্পষ্ট করছি একেকটি শতকের গল্প। সুখ স্মৃতির মাঝে রয়েছে কালো ছায়া, আছে শেষবার ব্যাট উঁচিয়ে ধরা ম্যাচের একরাশ হতাশা। তাই তো ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তাঁর’- প্রবাদে মোটেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না শচীন, তা অকপটে বলা যায়।

১৯৮৯ সালের ১৫ নভেম্বর প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন তিনি। করাচীতে অভিষেক ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করার সুযোগ পেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে নামা হয়নি তাঁর। একটিমাত্র ইনিংস থেকে করেছিলেন ১৫ রান। ১৫ দিয়ে শুরু করা শচীনের ক্যারিয়ার শেষে রান সংখ্যা গিয়ে ঠেকে এভারেস্টের চূড়ায়। বিদায়বেলা ১৬ নভেম্বর ২০১৩ সালে ৩৪,৩৫৭ রানের মালিক বনে যান ক্রিকেটের এই বরপুত্র। আলাদাভাবে ওয়ানডে’তে ১৮,৪২৬ রান, টেস্টে ১৫,৯২১ রান এবং টি-টোয়েন্টি’তে ১০ রান।

ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে করেছেন ওয়ানডে ক্রিকেটের দ্বিশতক। প্রতিপক্ষ হিসেবে সবচেয়ে বেশিবার ব্যাট উঁচিয়ে ধরার সুযোগ হয়েছে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সর্বমোট ৯টি শত রানের ইনিংস রয়েছে তাঁর। মজার বিষয় হলো, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে শতকের সূচনাটাও করেছিলেন একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বেশি জয়ও তাদের বিপক্ষেই।

১৮ ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক ঘটে শচীন টেন্ডুলকারের। বিসমিল্লাহ্তেই গলদ করেছিলেন তিনি। সেদিন তাকে ০ রানে প্যাভিলিয়নের পথ ধরিয়ে দেন পাকিস্তানি বোলাররা। সেই থেকে ধুঁকতে ধুঁকতে কেটে যায় চার চারটি বছর। মাঝখানের সময়টাতে নানান চড়াই উতরাই পেরিয়ে ভারতীয় দলে নিজের জায়গা পোক্ত করার কাজে মত্ত শচীন। ক্যারিয়ার জুড়ে শতকের ফুলঝুড়ি যার, দুয়ারে গিয়েও হুঁচট খান বারবার, একটি শতকের অপেক্ষা গোটা বছর চার।

ম্যাচ নাম্বার পাক্কা ৭৮। ১৯৯৪ সালে তৎকালীন সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ খেলতে শ্রীলংকা যায় ভারত। টুর্নামেন্টের তৃতীয় ম্যাচে কলম্বোতে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামে তারা। আগে ব্যাট করা ভারতীয় ওপেনার শচীন ছুঁয়ে যান তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার। ৮ চার এবং ২ ছক্কায় ১৩০ বল থেকে ১১০ রানের ঝকঝকে ইনিংসে জয় পেয়েছিল তাঁর দল। তবে উপমহাদেশের চায়ের দোকানের দর্শকমহলে একটি ভ্রান্ত ধারণা বরাবরই লক্ষণীয়। শচীনের শতক ‘আনলাকি’! যত শতক, তত দলের হার!

সেই ভ্রান্ত ধারণা থেকে আপনাকে বেরিয়ে আনতেই এই কিঞ্চিৎ প্রচেষ্টা। ৪৯টি সেঞ্চুরী থাকা ওয়ানডে ক্রিকেট দিয়েই শুরু করা যাক। শচীনের সেঞ্চুরী উদযাপনের দিনে ৩৩ বার শেষ হাসি ভারতের। ১৪টি পরাজয়ের সাথে ড্র হয়েছে দুটি ম্যাচ। আলাদা প্রতিপক্ষ হিসেবে সর্বাধিক শতক রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৯টি। যার মধ্যে সাতটি জয় এবং দুইটি পরাজয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রীলংকার বিপক্ষে সেঞ্চুরী করে ম্যাচ জিতিয়েছেন পাঁচ বার। বিপরীতে তিন হার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাঁচ সেঞ্চুরীর তিনটি জয়, দুটি হার। তবে সমান সংখ্যক ম্যাচে সেঞ্চুরী করে সবকটি জিতে নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চার সেঞ্চুরীতে তিনটি জয় পেলেও হেরেছে একটিমাত্র ম্যাচ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চার জয়, এক হার। খর্বশক্তির প্রতিপক্ষ কেনিয়ার বিপক্ষে চার সেঞ্চুরীর সবকটি জয় তোলে নিয়েছে শচীনের দল। একমাত্র সেঞ্চুরীর ম্যাচে নামিবিয়ার বিপক্ষেও জয়।

তবে শচীনের সেঞ্চুরী সবচেয়ে বেশিবার বিফলে গিয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে। পাঁচ বার শত রানের ইনিংস খেলেও দলকে জয়ের স্বাদ দিতে পেরেছিলেন মাত্র একবার। বাকি চার ম্যাচে পাকিস্তানের জয়। মজার বিষয় হলো, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি সেঞ্চুরী রয়েছে শচীনের। ঐ দুটি ম্যাচই ড্র হয়েছিল বৃষ্টি বাঁধায়। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে শেষবার ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছিলেন ঢাকায়। বাংলাদেশের বিপক্ষে শত রানের ইনিংস খেলেও সেদিন পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় শচীনদের। তাঁর ১১৪ রান ম্লান করে পাঁচ উইকেটের দুর্দান্ত জয় পেয়েছিল সাকিব-তামিমরা।

ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানকে নিয়ে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক তথ্য, তিনি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন মাত্র একটি! সেই ম্যাচ থেকে করেছিলেন ১০ রান। তবে অভিজাত সংস্করণ টেস্টে শতকের অর্ধশতক পূর্ণ করেছেন শচীন। সেঞ্চুরীর খাতা খুলেছিলেন ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৩ সালে। ঘরের মাঠ চেন্নাইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৫ রানের ইনিংস খেলার মাধ্যমে। সাদা পোশাকে একান্ন সেঞ্চুরীতে জয় পরাজয়ের পরিসংখ্যান প্রায় সমানে সমান। শচীনের ব্যাট তিন অংক ছুঁয়েছে, এমন ম্যাচে ভারতের জয় মোট ২০ বার। ড্র হয়েছে সমান সংখ্যক ম্যাচ। সেঞ্চুরী করেও হারের তিক্ত স্বাদ পেতে হয়েছে ১১ বার।

দীর্ঘ দুই যুগের (প্রায়) খেলোয়াড়ি জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা, পুরস্কার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ভারত রত্ন (২০১৪), পদ্ম ভূষন (২০০৮), রাজীব গান্ধী খেল রত্ন (১৯৯৭), পদ্ম শ্রী (১৯৯৯), উইসডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার (১৯৯৭), আইসিসি ওডিআই টিম অব দ্য ইয়ার (২০০৪, ২০০৭, ২০১০), স্যার গারফিল্ড সবার্স ট্রপি (২০১০), উইসডেন লিডিং ক্রিকেটার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (১৯৯৮, ২০১০), অর্জুনা এ্যাওয়ার্ড ফর ক্রিকেট (১৯৯৪), মহারাস্তা ভূষণ এ্যাওয়ার্ড (২০০১), লরিস স্পোর্টিং মোমেন্ট ২০০০-২০২০ এ্যাওয়ার্ড (২০২০), এলজি পিপলস চয়েস এ্যাওয়ার্ড (২০১০), উইসডেন ইন্ডিয়া আউটস্ট্যান্ডিং আচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড (২০১২), আউটস্ট্যান্ডিং আচিভমেন্ট ইন স্পোর্টস (২০১০), পিপলস চয়েস এ্যাওয়ার্ড (২০১০), ওয়ার্ল্ড টেস্ট একাদশ (২০০৯, ২০১০, ২০১১), ক্যাসট্রল ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার (২০১১), বিসিসিআই ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার (২০১১)।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »