একটু ভালো খেললেই জাতীয় দলে নিয়ে আসা এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবেঃ শান্ত

দুর্জয় দাশ গুপ্ত »

১৯৯৫ সালে শারজায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক হয় পেসার হাসিবুল হোসেনের। ডাক নাম শান্ত। নামে শান্ত হলেও মূল কাজটা ছিলো প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের গতি আর সুইংয়ে ভোগানো।

অভিষেকের বছর দুয়েক পরে অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফতে বল হাতে বড় ভূমিকা পালন করেছেন হাসিবুল হোসেন শান্ত। ঐ টুর্নামেন্টে শিকার করেন ১১ টি উইকেট।

মূলত একজন বোলার হলেও শান্ত বিখ্যাত ব্যাটিংয়ের জন্য। আইসিসি ট্রফির ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে শেষ বলে জয়ের জন্য ১ রানের প্রয়োজন ছিলো বাংলাদেশের। হাসিবুল হোসেন মূলত দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের বড় এক অংশ হয়ে আছেন ব্যাট হাতে সেই ম্যাচটাকে জয়ে রূপান্তরিত করায়।

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর অবসর সময়টাতে মুঠোফোনে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম এই নায়ককে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়নি। নামের মত মানুষ হিসেবেও হাসিবুল হোসেন শান্ত খুবই শান্ত প্রকৃতির। দেশের ক্রিকেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা গেল তাঁর সাথে।

পাঠকদের জন্য হুবহু সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

নিউজক্রিকেট: বাংলাদেশের পেসাররা দেশের মাটিতে যতটা উজ্জল বিদেশের মাটিতে ততটা উজ্জ্বল নয় এর কারণটা কি?

হাসিবুল হোসেন শান্ত: আমাদের যারা পেস বোলার আছে তারা কিন্তু ইদানিং দেশের বাইরে ভালো করছে। তাদের অভিজ্ঞতা বাড়ছে, অনেক খেলা হচ্ছে। মূলত আমাদের দেশের উইকেট যেটা রয়েছে একদম ফ্ল্যাট উইকেট থাকে। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের যে লেন্থে বল করতে হয়… আমি মনে করি আমাদের দেশে যে উইকেট গুলো আছে সেগুলো যদি একটু বাউন্সি হয় তাহলে ভালো হয়। যখন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় খেলা হয় তখন লেন্থ এর দিক থেকে একটু প্রবলেম হয়। আমাদের দেশের উইকেট এর উপর উপর নির্ভর করছে বোলারদের অনেক কিছু।

নিউজক্রিকেট: ঘরোয়া ক্রিকেটের মৌসুমটা কি ঠিক সময় শুরু হয় বলে আপনার কাছে মনে হয়?

হাসিবুল হোসেন শান্ত: আমাদের দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে কিন্তু অনেক খেলা হয়। যখন ক্রিকেটের মৌসুম থেকে তখনো খেলা হয় যখন থাকেনা তখনও কিন্তু খেলা হয়। মূল বিষয়টা হলো কি বোলারদের নিজেরা নিজেদের কিছু কাজ করতে হয়।

নিউজক্রিকেট: এই উপমহাদেশের দেশ হিসেবে ভারত-পাকিস্তান থেকে ভালো ভালো পেসার বের হয়ে আসে কিন্তু আমাদেরে দেশ থেকে ভালো পেসার আসে না, উইকেটেও কিন্তু প্রায় একই রকম হয় কেন এমন হচ্ছে?

হাসিবুল হোসেন শান্ত: আমি ইন্ডিয়াতে খেলেছি. পাকিস্তানেও খেলেছি। পাকিস্তানের কিছু ভাল উইকেটও আছে আবার কিছু ফ্ল্যাট উইকেটও আছে। ওরা যখন থেকে খেলা শুরু করেছে আমরা কিন্তু তখন থেকে খেলা শুরু করিনি। একটা পেস বোলারদের কিন্তু নিজেদের কিছু করার রয়েছে। ভারত-পাকিস্তানে পেসারদের যে গ্রোথ আর বাংলাদেশ গ্রোথ সেটা কিন্তু এক না। পেস বোলারদের ক্যারিয়ার কিন্তু ছোট হয়। তাই একটা পেস বোলারকে ফিট রাখতে হলে অনেক কিছুই করতে হয়। আমাদের দেশের উইকেট যদি ভালো না হয় তাহলে আমাদের দেশের পেস বোলারদের জন্য খুব কঠিন হবে।

নিউজক্রিকেট: তার মানে কি বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের উইকেট গুলোতে বৈচিত্র্য আনা দরকার?

হাসিবুল হোসেন শান্ত: প্র্যাকটিসে রাখতে পারে। পাকিস্তান কিংবা ভারত কিন্তু অনেক বড় দেশ ওদের অনেক ক্রিকেট মাঠ রয়েছে আবার ওয়েদারও একেক জায়গায় একেক রকম। আমাদের দেশ ছোট, কয়েকটা মাঠ। এর মধ্য থেকেই কিন্তু পেসারদের ভালো করতে হবে। এখানে উইকেটে তেমন কিছু না থাকলে তো বাউন্সটা থাকতে হবে। যাতে বোলারদের সুবিধা হয় আবার ব্যাটসম্যানদের সুবিধা হয়। এরকম উইকেট থাকলে কিন্তু পেস বোলাররা ভালো করতে পারে। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে দেখা যায় যে দুই একটা ম্যাচের উইকেট বাউন্স থাকে, এরপর আর কোনো ম্যাচই দেখা যায় না। এইগুলো নিয়ে কিন্তু বোর্ড এখন কাজ করছে।

নিউজক্রিকেট: আমাদের দেশের পেস বোলারদের মধ্যে সুইং কেন দেখা যায় না, এর কারণটা কি?

হাসিবুল হোসেন শান্ত: এটা আসলে বল এর উপর নির্ভর করে। এখন কিন্তু বিশ্বে ওইভাবে সুইং বোলার পাওয়া যায় না। ভারতে কয়েকজন রয়েছে শেষ টেস্ট যেটা আমরা বাজেভাবে হারলাম। আমাদের দেশেও কিন্তু সুইং বোলার রয়েছে কিন্তু ওভাবে দেখা যায় না। আসলে সবকিছু নির্ভর করছে উইকেটের ওপর। উইকেট যদি ভাল হয় তাহলে একটা বোলার কিন্তু শিখতে চায় কিভাবে সুইং করাতে হয়, কিভাবে আউট সুইং কিংবা ইন সুইং করাতে হয়। ভালো উইকেট দিলে কিন্তু সবাই শিখতে পারবে।

নিউজক্রিকেট: অনূর্ধ্ব-১৯ দল যারা বিশ্বকাপ জিতলো সেই দলে কিন্তু ভালো ভালো কয়েকজন পেসার রয়েছে তাদের নিয়ে কেমন পরিকল্পনা করা উচিৎ?

হাসিবুল হোসেন শান্ত: ওদেরকে নিয়ে কিন্তু পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এখন করোনার কারণে হয়তোবা একটু থেমে রয়েছে। কিন্তু ওদের মাঝে যাদের মধ্যে সম্ভাবনা রয়েছে জাতীয় দলে খেলবে ওদেরকে নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

নিউজক্রিকেট: জাতীয় দলের বিদেশ সফরে প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিৎ?

হাসিবুল হোসেন শান্ত: জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা যেই কন্ডিশনের খেলতে যায় তার উপর নির্ভর করেই কিন্তু অনুশীলন করে। তবে আপনি যত কিছু্ই বলেন না কেনো উইকেট যতক্ষণ না পর্যন্ত ভালো না করবেন আপনি যে কন্ডিশনেই অনুশীলন করে যান না কেন, লাভ হবে না। দুই মাস তিন মাস ট্রেনিং করে অনুশীলন করে ভালো ফল আশা করা সম্ভব হয় না।

নিউজক্রিকেট: আপনি তো ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ে নায়ক ছিলেন মাঠে থেকে সেটা উপভোগ করেছেন। সেই ট্রফি জয়ে মূলমন্ত্রটা কি ছিলো?

হাসিবুল হোসেন শান্ত: আমরা আবেগ দিয়ে ক্রিকেটে খেলেছি, আমাদের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল। আমরা কখনো ভাবি নি যে বাংলাদেশের ক্রিকেট এই পর্যায়ে আসবে। মনের মধ্যে ছিলো কিছু একটা করবো। মনের মধ্যে আন্তরিকতা থাকলে এমনি ভালো কিছু করা সম্ভব, যেটা আমাদের মধ্যে ছিল। সবাই ভালো খেলেছে এমন না যে একজন-দুইজন ভালো খেলেছে। দলগত পারফরম্যান্স করেছিলাম বলেই আইসিসি ট্রফিটা জিতেছিলাম। আইসিসি ট্রফিটা না জিতলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের এতদূর আসতো কিনা সন্দেহ ছিল।

নিউজক্রিকেট: আপনারা যখন ক্রিকেট খেলেছেন তখনকার আর এখনকার মধ্যে পার্থক্য কোন জায়গায়?

হাসিবুল হোসেন শান্ত: আমরা সেই সময় কোনো সুবিধাই পেতাম না। আসলে যা করেছি মন থেকে করেছি ভেতর থেকে ছিল আমাদের কিছু একটা করবে। সত্যি কথা বলতে কেমন লাগবে তবুও বলি আমাদের মধ্যে আমরা যেরকম মেন্টালি স্ট্রং ছিলাম আমি এখনকার ক্রিকেটারদের মধ্যে সেটা দেখি না। আমাদেরকে কিন্তু কেউ শিখিয়ে দেয়নি, আমরা নিজে থেকে শিখেছি। এখন যে ধরনের সুবিধা ক্রিকেট বোর্ড দেয় ক্রিকেটারদের আরও পরিশ্রমী হওয়া উচিৎ। তাহলে কিন্তু আর ভালো ভালো ক্রিকেটার বের হয়ে আসবে সেই সম্ভবনাও রয়েছে।

নিউজক্রিকেট: জাতীয় দলে প্রবেশের ক্ষেত্রে কি আমরা বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলি, যার কারণে ক্রিকেটাররা তাদের ক্যারিয়ার বড় করতে পারেনা।

হাসিবুল হোসেন শান্ত: এই একটা জিনিস পরিবর্তন করতে হবে। ন্যাশনাল লিগ থেকে যারা ভালো করতেছে, একটু ভালো খেললেই দলে সুযোগ পাচ্ছে। এ জিনিসটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবে তাদের কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেট বেশি খেলে আসতে হবে তাহলে আমরা ভালো খেলতে পারব। বিশেষ করে লংগার ভার্সনের ক্রিকেটটা ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশি খেলে আসতে হবে তাহলেই আমরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আরও ভালো করতে পারবো।

নিউজক্রিকেট: আপনাকে অসংখ্যা ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য

হাসিবুল হোসেন শান্ত: আপনাকেও ধন্যবাদ।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »