মাশরাফির যোগ্য উত্তরসূরী হতে চান বিশ্বকাপ জয়ী অভিষেক

দুর্জয় দাশ গুপ্ত »

নড়াইলের তরুণ তুর্কি অভিষেক দাসের গল্পটা অন্য দশটা ক্রিকেটারের চেয়ে ভিন্ন। অভিষেকের শুরুটা হয় ব্যাডমিন্টন দিয়ে। তখনো অভিষেক জানতেন না ক্রিকেটের সাথে জড়িয়ে যাবেন এবং একদিন দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জয় করবেন। জেলা পর্যায়ে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়েছিলেন বাবার সাথে। সেখানে গিয়েই এক কোচের কথায় নিজের ছেলেকে ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন অভিষেকের বাবা। আর দশটা পরিবারের মত অভিষেকের পরিবার থেকে কোন বাঁধা আসেনি। বরং সবসময়ই পরিবার থেকে পেয়েছেন সমর্থন।

নড়াইলের সেই ছোট্ট অভিষেক আজ বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেটার। হোক না অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ তবুও তো দেশের হয়ে প্রথম। এই সাফল্য থেকে প্রেরণা নিয়েই ভবিষ্যতে দেশের জন্য আরো ভালো কিছু করতে চান তিনি।

জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্ত্তজার এলাকার ছেলে অভিষেকও হতে চান ভবিষ্যতে দেশের ক্রিকেটের কান্ডারি। অভিষেকের ক্রিকেটে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণাও যে মাশরাফি।

মুঠোফোনে বিশ্বকাপ জয়ী এই তরুণ ক্রিকেটারের সাথে হলো অনেক আলোচনা। নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কমকে অভিষেক জানিয়েছেন নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও।

পাঠকদের জন্য পুরো সাক্ষাৎকার হুবহু তুলে ধরা হলো।

নিউজক্রিকেটঃ ক্রিকেটের সাথে যে পথচলা সেটার শুরুটা কিভাবে হয়েছিলো?

অভিষেক দাসঃ আসলে ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিলো। পাড়ায় ক্রিকেট খেলতাম তখন থেকেই। ক্রিকেটের পাশাপাশি আমি ব্যাডমিন্টনটাও ভালো খেলতাম। আমাদের জেলায় একটা ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট হতো৷ বাবার সাথে তখন ব্যাডমিন্টন খেলতে চাই। তখন সেখানে আমাদের জেলা কোচ ছিলেন যিনি আমার বাবাকে বলেন আমাকে ক্রিকেটে দিতে। কারণ আমার শারীরিক গঠন ক্রিকেটের জন্য উপযোগী ছিলো। ক্রিকেট বলে অনুশীলন তখন থেকেই শুরু হয়। আমার পরিবার আমাকে সাপোর্ট করেছে খুব। এছাড়া মাশরাফি ভাইকে দেখেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি। উনার খেলা দেখতাম ছোট বেলা থেকেই।

নিউজক্রিকেটঃ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ মিলে কিভাবে?

অভিষেক দাসঃ বয়স ভিত্তিক ক্রিকেট দিয়েই আস্তে আস্তে সুযোগ মিলেছে। আমি যখন অনূর্ধ্ব -১৬ ডিভিশনে দলে খেলছিলাম কক্সবাজারে তখনই আমি অনূর্ধ্ব -১৭ দলে ডাক পাই। অনূর্ধ্ব -১৯ দলের ক্যাম্প শুরু হওয়ার আগে কয়েকটা টেস্ট ম্যাচের একটা সিরিজ হয়। আমার তখন এইচ এস সি পরীক্ষা চলছিলো। তারপরও একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পাই। সে ম্যাচে ভালো করার পরেই অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ডাক আসে।

নিউজক্রিকেটঃ বিশ্বকাপের জন্য পরিকল্পনা কেমন ছিলো?

অভিষেক দাসঃ গত দুই বছর ধরে বিশ্বকাপের আগে আমি অনেক পরিশ্রম করেছি। ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড সিরিজেও ভালো করেছি। আমি প্রস্তুত ছিলাম যে বিশ্বকাপে যদি একটা সুযোগও পাই তবে সেটা কাজে লাগাবার জন্য। আমার মাথায় এটাই ছিলো সুযোগ পেলে ভালো করার।

নিউজক্রিকেটঃ বিশ্বকাপের মত বড় মঞ্চে খেলতে গিয়ে স্নায়ুরও একটা বড় পরীক্ষা দিতে হয়েছে নিশ্চয়ই।

অভিষেক দাসঃ আসলে বড় মঞ্চে খেলতে গেলে যেকোনো প্লেয়ারেরই নিজস্ব একটা পরিকল্পনা থাকে। বিশ্বকাপের মত মঞ্চে খেলতে গিয়ে একটু ভালো লাগা তো ছিলোই। কিন্তু সত্যি কথা হলো আমি ওরকমভাবে ভাবিনি যে কি হবে। কোন ভয়ও কাজ করছিলো না। আমি শুধু আমার ন্যাচারাল খেলাটাই খেলতে চেয়েছি।

নিউজক্রিকেটঃ বিশ্বকাপের আগে কয়েকটা সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ৷ তবুও বিশ্বকাপে কয়েকটা বড় দলের বিপক্ষে বাংলাদেশকে খেলতে হবে। সেদিক চিন্তা করলে থেকে দলের পরিকল্পনা কি ছিলো আর দলের সবাই কি আত্মবিশ্বাসী ছিলো?

অভিষেক দাসঃ দেখেন আমরা গত দুই বছর ধরে একসাথে আছি। এবং আমরা অনেক ম্যাচ খেলার সুযোগও পেয়েছি। বোর্ড আমাদের অনেক সুযোগ দিয়েছে। ঐখান থেকেই আমাদের দলের বোঝাপড়াটা বেশ ভালো ছিলো৷ আর আমরা সবসময়ই দল হিসেবে খেলতে চেয়েছি। কেউ একজন অসাধারণ কিছু করবে এমন পরিকল্পনা ছিলো না। আমরা সবাই নিজেদেরকে প্রস্তুত করেছি এবং সেরাটা দেবার চেষ্টা করেছি। এছাড়া আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিলো যে আমরা ভালো করতে পারবো। বিশ্বকাপের আগের সিরিজগুলোতেও আমরা ভালো করেছি। পরিকল্পনা একটাই ছিলো আমরা দেশের জন্য কিছু করবো।

নিউজক্রিকেটঃ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের টার্নিং পয়েন্ট কোনটা ছিলো?

অভিষেক দাসঃ আমি বলবো পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটা। ঐ ম্যাচটা গ্রুপ পর্যায়ে আমাদের শেষ ম্যাচ ছিলো। সবকটা ম্যাচের কথা চিন্তা করলে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটাতেই আমরা সবচেয়ে খারাপ খেলেছি। আমরা প্রায় অলআউট হয়ে যাচ্ছিলাম। ঐ ম্যাচটা যদি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত না হতো এবং আমরা হেরে যেতাম তাহলে আমাদের টিমের উপর হয়তো একটা প্রভাব ফেলতো৷ আমি মনে করি ঐ ম্যাচটা না হওয়াতে আমাদের জন্য ভালো হয়েছে কারণ কোয়াটার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেয়েছি। আমরা পুরো টুর্নামেন্টেই নিজেদের ন্যাচারাল ক্রিকেটটা খেলেছি তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটা আমরা একটু খারাপ খেলেছি।

নিউজক্রিকেটঃ প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার সবে শুরু হল। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

অভিষেক দাসঃ প্রিমিয়ার লিগটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমি মনে করি। আমার ক্যারিয়ারের প্রথম লিগ ছিলো এবার। একটা ম্যাচেও পরে করোনার কারণে লিগ বন্ধ হয়ে গেল। আমার একটা পরিকল্পনা ছিলো লিগটাকে ঘিরে। যেকোনো উঠতি ক্রিকেটারের জন্যই এই লিগটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সবসময়ই আমার পরিকল্পনা থাকে নিজের সেরাটা দেওয়ার৷ তবে ক্রিকেটে সবসময় সফল হওয়া যায় না। ভালো আর খারাপ মিলেই ক্রিকেট। আমার চেষ্টা থাকবে সবসময়ই ভালো কিছু করার। অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্স করার লক্ষ্যই সবসময় থাকে।

নিউজক্রিকেটঃ সামনে হয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ মিলবে যদি পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারেন। কোন ফরম্যাটটাকে ঘিরে পরিকল্পনা করছেন?

অভিষেক দাসঃ একজন ক্রিকেটার হিসেবে তিনটা ফরম্যাটে খেলা সব ক্রিকেটারেরই একটা স্বপ্ন। আমার চেষ্টা থাকবে তিন ফরম্যাটের জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করার৷ এবং পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চেষ্টা থাকবে।

নিউজক্রিকেটঃ মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করাও একটা বড় ব্যাপার। এ দিকটা কিভাবে দেখছেন?

অভিষেক দাসঃ আসলে ক্রিকেটের তিনটা ফরম্যাটের জন্য নিজেকে আলাদাভাবে তৈরি করতে হয়। মানসিকভাবেও সেভাবে তৈরি হতে হয়। সাদা বল এবং লাল বলের ফরম্যাট একদমই ভিন্ন। আমিও সেভাবেই নিজেকে তৈরি করার চেষ্টায় আছি। বাড়িতে অবসর সময়টাতে বসে বসে পুরনো ম্যাচ গুলো দেখছি। অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটারের খেলা দেখছি। কিছু বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি।

নিউজক্রিকেটঃ একজন ক্রিকেটারের জন্য মাঠের বাইরে থাকা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার৷ অনেক বড় বড় ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রেও একই। সেদিক থেকে চিন্তা করলে আপনারা কেবল শুরু করেছেন। এত লম্বা সময় ধরে মাঠের বাইরে থেকে নিজেদের ফিটনেস ধরে রাখা কতটা চ্যালেঞ্জিং?

অভিষেক দাসঃ আসলে এখন এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি যেখানে চাইলেও অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। সবসময় ঘরেই থাকতে হচ্ছে৷ ঘরে থেকেই ফিটনেসের জন্য বিভিন্ন কাজ করতে হচ্ছে যেটা হয়তো আগে কখনো করতে হয়নি। তবে ঘরে বসেই চেষ্টা করে যাচ্ছি যতটুকু পারা যায় চালিয়ে যাওয়ার। ব্যাটিং কিংবা বোলিং করা এখন তো অসম্ভব প্রায়। কাজেই যা করার ঘরে বসেই করতে হচ্ছে। অবশ্যই এই ব্যাপারটা খুবই চ্যালেঞ্জিং।

নিউজক্রিকেটঃ আপনি তো একজন অলরাউন্ডার সেক্ষেত্রে ব্যাটিং নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি থাকে?

অভিষেক দাসঃ বিশ্বকাপের কথাই যদি বলি অলরাউন্ডার হিসেবে খেললেও আমি কিন্তু শেষের দিকে ব্যাটিং করেছি। এই পরিস্থিতিতে ম্যাচের অবস্থা বুঝে ব্যাট করতে হয়। অনেক সময় ৩০ বলে ১০-১৫ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ বের করে নিয়ে আসতে হয় আবার অনেক সময় ১০ বলে ৩০ রানের একটা ইনিংস দল আমার থেকে চাইবে। আমি আমার দিক থেকে দল যেটা চেয়েছে সেটাই করার চেষ্টা করেছি। আমি মূলত একটু আগ্রাসী ব্যাটিং করতে পছন্দ করি। তবুও সবসময় মাথায় থাকে দল আমার থেকে কি চায় এবং ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে ব্যাট করার চেষ্টা করি।

নিউজক্রিকেটঃ ক্রিকেটে আপনার আদর্শ কে দেশে এবং দেশের বাইরে?

অভিষেক দাসঃ আসলে আমি ছোটবেলা থেকে এভাবে কাউকে বিশেষভাবে আদর্শ হিসেবে দেখি না। তবে দেশের ভেতরে পেস বোলিং অলরাউন্ডারের কথা বললে আমি বলবো সাইফউদ্দিন ভাইয়ের কথা। আর দেশের বাইরে শেন ওয়াটসন আর হার্দিক পান্ডিয়া।

নিউজক্রিকেটঃ নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কমের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।

অভিষেক দাসঃ আপনাকেও ধন্যবাদ এবং নিউজ ক্রিকেটের সকল পাঠকদের শুভেচ্ছা।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »