জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট থেকে আরও এক নক্ষত্রের অবসান

নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডেস্ক »

ক্রিকেটের সৌরজগতে জিম্বাবুয়ে যেন হারিয়ে যাওয়া এক গ্রহের মত অবস্থায় আপতিত এক গ্রহের নাম। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের এমন কালো দিন আসবে এটা হয়তো ভাবাও দুষ্কর ছিলো । যারা ১৯৯৫ কিংবা ১৯৯৭ সাল থেকে ক্রিকেট নিয়মিত দেখে আর অনুসরন করে তারা হয়তো কখনোই বিশ্বাস করতে পারবে না। একটা সময় আজকের এই জিম্বাবুয়েকে ভাবা হত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উঠতি এক নতুন পরাশক্তি। কালের পরিক্রমায় সবই আজ হারিয়ে যাবার পথে। ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সালকে বলা হয় জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের স্বর্নযুগ। এন্ডি ফ্লাওয়ার, কার্নাইল, অ্যালিস্টার ক্যামবেল, হিথ স্ট্রিক কিংবা নিল জনসনরা অবসর নেয়ার পর থেকে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট আর সেভাবে দাঁড়াতে পারেননি।

২০০০ সালে জিম্বাবুয়ের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দেখা মিলে এক বিস্ময় তরুণের নাম হ্যামিল্টন মাসাকাদজা । ২০০০ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসেবে করেন সেঞ্চুরি। পরে আসতে আসতে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের মাধ্যমে জায়গা করে নেন জাতীয় দলে। একটা সময় এসে মাসাকাদজাকে ভাবা হত আগামী প্রজন্মের অ্যালিস্টার ক্যামবেল কিংবা কার্নাইল। ২০০১ সালে অভিষেকের পর থেকে ২০১৯ সাল এই ১৮ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দেখেছেন নানান উত্থান পতন পেরিয়ে এসেছেন অনেকটা পথ। সাক্ষী হয়েছেন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে নানা রকম সাফল্য ও ব্যর্থতার গল্পের। আজ জানবো হ্যামিল্টন মাসাকাদজার ১৮ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের নানা জানা অজানা গল্প।

জন্ম ও শৈশবঃ সময়টা ১৯৯৮৩ সালের ৯ ই আগষ্ট জিম্বাবুয়ের হারারে তে বসবাস করা মাসাকাদজা পরিবারে আগমন হয় এক পুত্র সন্তানের। পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে মিল রেখে নাম রাখা হয় হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। ছোট বেলা থেকেই ছিলো ক্রিকেটের প্রতি এক অঘাত ভালোবাসা। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের সোনালী যুগটাকে দেখেই ক্রিকেটের প্রতি এই অঘাত ভালোবাসা। ক্রিকেটের প্রতি মাসাকাদজার এমনই এক ভালোবাসার জন্ম নেয় যেখানে কি না তাঁর ছোট ভাই সেই সময়ের দুর্দান্ত ফুটবল খেলা শিঙ্গি মাসাকাদজাকে ক্রিকেটের দিকে আনেন। ব্যাটে বলের সাথে খেলতে খেলতেই আজকের জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের এক নক্ষত্র হ্যামিল্টন মাসাকাদজা।

ক্রিকেটের যাত্রা ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটঃ ক্রিকেটের প্রতি অঘাত ভালোবাসা আর ক্রিকেট নিয়ে অধ্যাবসায়ই পারে একজনকে পরিপূর্ণ ক্রিকেট হিসেবে তৈরী করতে। ক্রিকেটকে ভালোবাসলেই ক্রিকেটের ছায়াতলে জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়। একজন হ্যামিল্টন মাসাকাদজাও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। বয়স যখন মাত্র ৩/৪ বছর তখন থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তাঁর আগ্রহটা ফুটে। তাঁরপর থেকে ক্রিকেটেই ধ্যান, ক্রিকেটেই জ্ঞান ক্রিকেটকেই বেছে নিলেন নিজের মন ও প্রাণ। ঘরোয়া ক্রিকেটের শুরু থেকেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তবে নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরনটা সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে। ২০০০ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের প্রথম শতকের দেখা পান যা কি না জিম্বাবুয়ের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের প্রথম কোন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে করা সেঞ্চুরি।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে চমক দেখানো হ্যামিল্টন মাসাকাদজা পুরষ্কারও পেয়েছিলেন খুব তাড়াতাড়ি। ২০০০ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করার ঠিক বছর খানেকের মাঝেই গায়ে তোলেন স্বপ্নের জাতীয় দলের জার্সি। ক্রিকেটের অভিজাত ফরম্যাট টেস্ট দিয়েই শুরু হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পথচলা। ২০০১ সালের ২৭ শে জুলাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ( বর্তমানে উইন্ডিজ) বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক হয়। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের সেঞ্চুরির রেশ মনে হয় তখনও কাটেনি তখনই নতুন আরও এক বিস্ময়ের জন্ম দেন সে সময়ের ১৮ বছর বয়সী হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। ২০০১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচেই করেন ১১৯ রান যা কি না সে সময়ের সবচেয়ে কম বয়সে অর্থাৎ ১৭ বছর ২৫৪ দিন বয়সে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুুরিয়ান হিসেবে নাম লেখান হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। পরে অবশ্য বাংলাদেশের মোহম্মদ আশরাফুল তার এই রেকর্ড দখল করেন। টেস্টে অভিষেকেই বাজিমাত করার পর ফিরে তাকাতে হয়নি পিছনের দিকে। সেঞ্চুরির ১ মাস পরেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ২০০১ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর তাঁর ওয়ানডেতে অভিষেক হয়। তাঁরপর থেকে এখন অবদি খেলে চলেছেন জিম্বাবুয়ের জাতীয় দলের হয়ে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রান সংখ্যাঃ ২০০১ থেকে ২০১৯ এই ১৮ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দেখতে হয়েছে অনেক উত্থান-পতন। হাজারো বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এখনও খেলে যাচ্ছেন জাতীয় দলের হয়ে। মাঝ খানে ৬ বছর স্বেচ্ছায় নির্বাসনে না থাকলে হয়তো ম্যাচ সংখ্যা আর রান সংখ্যাটাও আরও বেশি হতে পারতো। আজ আমরা তুলো ধরবো হ্যামিল্টন মাসাকাদজার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের রানের হিসাব। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা শুরু হয় টেষ্টের মাধ্যমে টেস্ট ক্রিকেট খেলার সুযোগ হয় ক্যারিয়ারের ১৩ বছর। সর্বশেষ টেষ্ট খেলেন ২০১৪ সালের ১২ ই নভেম্বর বাংলাদেশের বিপক্ষে। টেস্টের ১৩ বছরের ক্যারিয়ারে খেলেছেন মাত্র ৩৮ টি টেষ্ট। ৩৮ টেষ্টে ৭৬ ইনিংসে ৫০০৯ টি বল মোকাবেলা করে ৩০.০৪ গড়ে করেন ২২২৩ রান। টেস্ট ক্যারিয়ারে ৫ সেঞ্চুরির সাথে রয়েছে ৮ হাফ সেঞ্চুরি যেখানে রয়েছে সর্বোচ্চ ১৫৮ রানের একটি ঝলমলে ইনিংস। টেষ্টে ৭৬ ইনিংসে চারের মার ছিলো ২৬৪ টি আর ছয়ের মার ছিলো ২৩ টি ক্যারিয়ারে ২ বার ছিলেন নটআউট।

টেস্ট ক্রিকেটের এক মাস পরেই অভিষেক হয় ওয়ানডে তে সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেন ২০১৫ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ওয়ানডেতে ২০৯ ম্যাচ খেলে ২০৮ ইনিংসে ৭৭২৮ টি বল মোকাবেলা করে ২৭.৭৩ গড়ে ৭৩.২১ স্ট্রাইকরেটে করেন ৫৬৫৮ রান। ওয়ানডেতে টেস্টের সমান সংখ্যক ৫ সেঞ্চুরির সাথে রয়েছে ৩৪ হাফ সেঞ্চুরি যেখানে সর্বোচ্চ ১৭৮ রানের অপরাজিত কারিশম্যাটিক এক ইনিংস রয়েছে। ৫৮৫ চারের পাশাপাশি তার ছয়ের সংখ্যা ৮৬টি আর ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নটআউট ছিলেন মোটে ৪ বার।

টি-২০ তে ৬২ ম্যাচের ৬২ ইনিংসেই ব্যাট করে ১৩১৯ বল মোকাবেলায় ১১৫ স্ট্রাইকরেট ও ২৫.৪৮ গড়ে তার রান সংখ্যা ১৫২৯। টি-২০ তে কোন শতকের দেখা না মিললেও করেছেন ১০ হাফ সেঞ্চুরি। টি-২০ ৬২ ম্যাচে চারের সংখ্যা ছিলো ১৩৯ আর ছয়ের সংখ্যা ৫৯ টি।

বল হাতে মাসাকাদজাঃ ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি দলের প্রয়োজনের সময়ে বল হাতেও হাত ঘোরাতে জানতেন মাসাকাদজা তবে ব্যাট হাতে যতটা সফল তিনি বল হাতে তার উল্টো চিত্র। টেষ্ট ক্রিকেটে ৩৮ ম্যাচে ২৪ ইনিংসে বল করার সুযোগ পান যেখানে ১১৬৪ টি বল করে ৪৮৯ রান দিয়ে নিজের ঝুলিতে ভরেন মাত্র ১৬ উইকেট। ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ বোলিং ফিগার ২৪ রানে ৩ উইকেট। ওয়ানডেতেও খুব একটা সফল নন বল হাতে। ২০৯ ম্যাচের ৮৫ ইনিংসে ১৮৪৪ টি বল করে ১৬৩৬ রান দিয়ে নেন মাত্র ৩৯ উইকেট। ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ বোলিং ফিগার ৩৯ রানে ৩ উইকেট। টি-২০ তেমনভাবে বল করার সুযোগ মিলে নি। ৬২ ম্যাচের মাত্র ৯ ইনিংসে বল করেন। আর এই ৯ ইনিংসে ৭২ বল করে ১১৩ রান দিয়ে তার সংগ্রহ মাত্র ২ উইকেট।

আন্তর্জাতিক রেকর্ডঃ অ্যালিস্টার ক্যামবেল, কার্নাইল কিংবা এন্ডি ফ্লাওয়ারদের বিদায়ের পর জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট সেভাবে আর নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মেলে ধরতে পারেনি। হ্যামিল্টন মাসাকাদজা ক্যারিয়ারের শুরুতে যেমন আভাস দিয়েছিলেন মাঝ পথে এসে ঠিক সেভাবে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। ক্যারিয়ারের শুরুটা রেকর্ড দিয়ে শুরু হলেও পরে আর খুব বেশি রেকর্ডে নিজেকে জড়াতে পারেননি।

দেখে নেয়া যাক তাঁর কয়েকটি রেকর্ডঃ ১. জিম্বাবুয়ের প্রথম শ্রেণিতে ১ম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে সেঞ্চুরি ( ২০০০ সালে) ২. অভিষেক ম্যাচে সবচেয়ে কম বয়সে শতক হাঁকান ( ২০০১ সালে মাত্র ১৭ বছর ২৫৪ দিন বয়সে) ৩. উদ্বোধনী জুটিতে ভুসি সিবান্দাকে নিয়ে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ১৬৭ রানের জুটি করেন। ( ২০০৭ সালে, বিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

বিদায় বেলাঃ বিদায় শব্দটাই যেন এক কষ্টের নীল সাগর তবে মানুষের আসা যাওয়া ছিলো, আছে, থাকবে এ যেন এক প্রকৃতির নিয়ম। ক্যারিয়ারটা জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের স্বর্নযুগে শুরু হলেও ক্যারিয়ারটা শেষ হচ্ছে এক চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে থাকার মত অবস্থা নিয়ে। ক্রিকেটের এই মহাজগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন জিম্বাবুইয়ান কিংবদন্তি হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট এখন এমন এক মহাসাগরে আপতিত যেখানে শুধুই নীল বিষ আর নীল বিষ। প্রত্যেকটা ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে নিজের দেশে বীরের মত করে নিবে কিন্তু সে কপালটাই বা থাকে কয়জন বীরের। তিনি সত্যিই একজন বীর একজন কিংবদন্তি। ২০০১ এর পর থেকে ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া দলটাকে টেনেছেন হাজারো ক্রান্তিকাল সময়ে। শত বাধাতেও হার মানেন নি তিনি লড়ে গেছেন ভালোবাসার টানে। জিম্বাবুয়ের হাজারও তরুন ক্রিকেটারের আইডল মাসাকাদজা। কিন্তু বিদায়টা হচ্ছে মলিন ভাবে। মাসাকাদজা কি নিজেও ভেবেছিলেন নিজেকে এমন এক ক্রান্তিকালে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হবে রেখে দিতে হবে ব্যাট,বল, প্যাড। গত ৩ রা সেপ্টেম্বর জিম্বাবুয়ে তাদের অফিসিয়াল পেজে মাসাকাদজার বিদায়ের বিষয়টা নিশ্চিত করেন। টুইটারে তারা লিখেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষনা দেন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টি-২০ সিরিজই হতে যাচ্ছে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শেষ মঞ্চ। তারা তাকে কিংবদন্তি হিসেবে আখ্যা দেন আর বলেন, ধন্যবাদ কিংবদন্তি। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট আবারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরবে কি না জানি না তবে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট একজন মাসাকাদজাকে মনে রাখবে হাজারও বছর। ধন্যবাদ হ্যামিল্টন মাসাকাদজা ধন্যবাদ কিংবদন্তি নিউজক্রিকেট২৪ পরিবারের পক্ষ থেকে রইলো আপনার জন্য অন্তত ভালোবাসা আর প্রার্থনা। সুন্দর কাটুক আপনার অবসর জীবন।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »