সাজিদা জেসমিন »
সদা হাসৌজ্জ্বল, প্রাণচঞ্চল নেতৃত্বের কথা বললে কার কথা মনে আসে? সাগড়পাড়ের একটি দ্বীপে জন্ম। সাগরের বিশালতার মতোই বিশাল তার মন। পক্ষ-বিপক্ষ না ভেবে সবাইকেই সানন্দে বুকে টেনে নেন। জয়-পরাজয় যাই হোক, মুখ সদা হাসৌজ্জ্বল। হাসিতেই জয় করেন সবার মন। জানতে চাইলে বলেন, মায়ের ইচ্ছে ছিলো সবসময় হাসিতে সবকিছু জয় করা।
বলছি ক্যারিবীয়ান রূপকথার এক নায়ক ড্যারেন স্যামির কথা। পূর্ব ক্যারিবীয়ান সাগড়পাড়ের সেন্ট লুসিয়া দ্বীপে জন্ম স্যামির। স্বদেশ থেকে প্রথম অধিনায়ক ছিলেন তিনি৷ প্রথম ক্রিকেটার তো বটেই। পার্শ্ববর্তী স্থান বার্বাডোজ থেকে যদিও বা বের হয়েছেন ক্যারিবীয়ান ক্রিকেটের বড় বড় সব স্টার। তবে আশ্চর্যজনকভাবে সেন্ট লুসিয়া থেকে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ছিলেন স্যামি। তাও ২০০৪সালে।
ক্যারিবীয়ান যে দুজন ক্রিকেটারের নামে সেখানে স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে তার মধ্যে স্যামি একজন। আর নিজের নামে তৈরি স্টেডিয়ামে স্যামি ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন। এমন সৌভাগ্যবান বোধহয় শুধু তাকেই বলা চলে। মুখ সদা হাসৌজ্জ্বল থাকে বলে ক্রিকেট বিশ্বে ‘স্মাইল ম্যান’ নামেই পরিচিত তিনি। খুব ভালোভাবেই হাসিমুখে সব পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন। যোগ্য একজন অধিনায়ক বললে বোধহয় ভুল হবেনা তেমন একটা।
অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সবসময় দাঁতে হাসি লেগেই থাকে। সেটা প্রতিপক্ষ হোক বা সতীর্থ। আর এ-ই ব্যক্তিত্বগুণেই ক্যারিবীয় ক্রিকেট আজীবন মনে রাখবে তাকে। অভিষেক টেস্টেই পেয়েছিলেন ৭উইকেট। কিন্তু ধারাবাহিকতার অভাবে যখনি হারিয়ে বসছিলেন নিজের স্থান তখনি আবার ক্যারিবীয় ক্রিকেটের দুর্দিনে ত্রাতা হিসেবে এসে হাল ধরলেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের। আর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন অনন্য এক উচ্চতায়।
ক্যারিবীয়দের ভার নিয়ে সাতাশ মাসের মাথায় এনে দেন দারুণ এক জয়। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে হন ম্যাচসেরা। ‘যখনই সুযোগ পেয়েছি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছি।’ – এ-ই বাণীর যথেষ্ট প্রতিফলন ঘটেছিলো তার প্রতিটা কাজে। জয়-পরাজয়, সুখ-দুঃখ যাই হোক সবসময় নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েছেন দেশের ক্রিকেটের জন্য।
অগোছালো নড়বড়ে একটা দলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন পুরোদমে। অদম্য মনোবল দিয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন
দলকে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসা ছেলেগুলোকে সাহস দিয়ে লড়াই করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
তেত্রিশ বছর পর বিশ্ব আসরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মেলে ধরেছিলেন বিশ্বের কাছে। গেইল-স্যামুয়েলসদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পতাকার জন্য লড়াই করেছেন। ‘নিজে হৃদয় দিয়ে লড়বো এবং অন্যদের মাঝেও লড়াইয়ের মানসিকতা জাগিয়ে তুলবো’ – এটাই ছিলো স্যামির বিশেষত্ব।
একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে দু’বার ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত আসরে বিশ্বসেরার মুকুট মাথায় পড়েছেন। যোগ্য নেতা হিসেবে সতীর্থদের সাহস দিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সমুদয় সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। পরের ম্যাচ খেলতে পারবেন কি পারবেন না, সেটা না ভেবেই নির্মম সত্যিটা তুলে ধরেছেন সবার সামনে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পরেই অর্থলিপ্সু বোর্ডকে কষে চাবুক মেরেছিলেন। সেটার জন্যই তাঁকে মূল্য দিতে হয় ক্যারিবীয় অধিনায়কত্ব হারিয়ে। তবে নতমস্তকে নয়, মাথা উঁচু করেই, বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হিসেবে নিজের অধিনায়কত্বের ইতি টানেন স্যামি।
একজন ড্যারেন স্যামিতে মুগ্ধ হন মিরাজ থেকে ফ্র্যাংকলিন, সবাই। গত বিশ বছরে স্যামির অধীনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আটটি টেস্ট জিতেছে। দু’টি টি-টোয়েন্টি শিরোপা জিতেছে। তার অধিনায়কত্ব নিয়ে যদিও বা অনেকে সমালোচনা করতেন। কিন্তু স্যামি এসব সমালোচনা পিছনে ফেলে খেলা উপভোগে বিশ্বাসী ছিলেন। সতীর্থদের বিনোদন দেওয়ার ক্ষেত্রেও স্যামি ছিলেন সেরা।
স্যার ওরেলের শিক্ষা থেকে দীক্ষা নিয়ে নিজেকে ঐভাবেই চালিয়ে নিয়ে গেছেন আজীবন। নিজেকে স্যার ওরেলের অনুসারী ভাবাটাকেই সবচেয়ে বড় ব্যাপার স্যামির কাছে। এ ব্যাপারে স্যামির মন্তব্য, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক মানে বড় ব্যাপার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক ফ্র্যাংক ওরেল থেকে শুরু করে কত যে বড় বড় নাম… আমি সেই মহান স্যার ওরেলের উত্তরাধিকারী। এটা অনেক বড় সম্মানের ব্যাপার । ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক মানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের গৌরবময় ঐতিহ্যের একজন ধারক। এটি এত বড় একটা দায়িত্ব যে, আমি এর জন্য জীবন ও দিয়ে দিতে পারি।’
স্যার ওরেলের আদর্শ লালন করে সেই জীবনাদর্শে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের এ-ই ধারকের আজ জন্মদিন। জন্মদিনে জানাই অঢেল শুভ কামনা। শুভ জন্মদিন হাসির ফুলঝুরি ড্যারেন স্যামি।