শেন ওয়ার্ন : বাইশগজের একজন ঘুর্ণি জাদুকর

নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডেস্ক »

বর্তমানের ক্রিকেট বিশ্বের চারপাশে লেগস্পিনারদের জয়জয়কার। ক্রিকেট বিশ্বের প্রায় সব দলেই রয়েছে একজন কিংবা দুইজন করে লেগস্পিনার যারা আজকের ক্রিকেট বিশ্বটাকে শাসন করছেন। আজকের ক্রিকেট জগতে আফগানিস্তানের রশিদ খান, দক্ষিন আফ্রিকার ইমরান তাহির,পাকিস্তানের শাদাব খান,ভারতের চাহাল অন্যতম সেরা লেগ স্পিনার তবে আপনাকে যদি বলা হয় আপনার চোখে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে ঘুর্ণি জাদুকরের নাম কি? অবশ্যই সেখানে শেন ওয়ার্নের নাম উঠে আসবে। শেন ওয়ার্ন এমন এক ক্রিকেট যুগে ক্রিকেট বিশ্বে আবির্ভুত হয়েছিলেন যখন কি না বিশ্ব ক্রিকেটে চলছে পেস বোলারদের আধিপত্য। এত এত পেস বোলারদের আধিপত্যের মাঝেও বাইশ গজে হাত ঘুরিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ঘটিয়েছে নানান ঘটনা যেখানে ছিলো কি না ভালো মন্দের সংমিশ্রণ। অ্যাশেজ টেস্টে মাইক গ্যাটিংকে লেগ স্ট্যাম্পের বাহিরে বল করে সেটি অফ স্ট্যাম্পের বেল ফেলতে সক্ষম হয় যা কি না বল অফ দ্যা সেঞ্চুরি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বল হাতে যেমন আলো ছড়িয়েছেন তেমনি মাঝে মাঝে লোয়ার অর্ডারে ব্যাট হাতেও আলো ছড়িয়েছেন দলের প্রয়োজনে। ২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সাল সময়টাতে যত জন অজি তারকা ক্রিকেট বিশ্বে আধিপত্য করেছেন তার মাঝে তিনি অন্যতম। ক্রিকেটের এই মহাতারকাকে নিয়ে জানবো তার ক্যারিয়ারের অনেক জানা-অজানা গল্প। জন্মঃ শেন ওয়ার্ন বিশ্বে ক্রিকেটের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনার তাতে কোন সন্দেহ থাকার উপায় নেই। ক্রিকেট এই মহাতারকার জন্ম ১৯৬৯ সালের ১৩ ই সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের ভিক্টোরিয়ার ফার্নট্রি গুল্লি এলাকায়। শেন ওয়ার্নের পুরো নাম শেন কেইথ ওয়ার্ন আর ডাক নাম ছিলো ওয়ার্নে, কিং অব স্পিন, শেক অব টুইক।

 

ক্রিকেটের শুরুঃ ১৯৯১ সালের মেলবোর্ন শহরের জংশন ওভালে ভিক্টোরিয়ার হয়ে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে শুরু হয় নিজের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ক্যারিয়ার। সে ম্যাচে ভিক্টোরিয়ার হয়ে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১ম ইনিংসে ১১ রানে ০ উইকেট ও ২য় ইনিংসে ৪৪ রানে ১ উইকেট দিয়ে শুরু হয় যাত্রা। তবে এর আগে তিনি ক্রিকেটের পাশাপাশি খেলেছেন ফুটবলও। ক্রিকেটে শুরুটা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৮৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮৭ সালে সেন্ট কিল্টা দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়ান নিয়ম অনুসারে ফুটবল দলে যোগ দেন। ১৯৮৮ তে সেন্ট কিল্টো অনু-১৯ দলের হয়ে ফুটবল খেলেন পরে তিনি ক্রিকেটে পুরোপুরি ক্রিকেটে মনোযোগী হন। ১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমীতে প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানো হলে পরের বছরই ইংলিশ ক্লাব অ্যাক্রিংটন ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে বল হাতে ১৫.৩১ গড়ে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন আর ব্যাট হাট হাতে ১৫ গড়ে ৩৩০ রান করেছিলেন। ১৯৯১ সালে হারারে স্পোর্টস ক্লাবে অস্ট্রেলিয়া বি দলের হয়ে ১ম ইনিংসে ৫ উইকেট বা তার বেশি উইকেট নেয়ার দখল করেন। পরে আর সেভাবে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারঃ বল হাতে তার তরুপের তাস লেগ স্পিনে ব্যবহার করে জিতেছেন নানা নিশানা বোকা বানিয়েছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদেরকে। আব্দুল কাদিরের পর ক্রিকেট বিশ্বে লেগ স্পিনে আলো ছড়ানো বোলারদের মাঝে শেন ওয়ার্ন নিঃসন্দেহে সেরা। ক্রিকেট এই মহাতারকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় ১৯৯২ সালের ২ রা জানুয়ারীতে । অস্ট্রেলিয়ার ৩৫০ তম টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে নিজের প্রথম টেস্ট খেলতে নামেন শেন ওয়ার্ন। যতটা প্রত্যাশার বারুদ নিয়ে তাকে ভারতের সাথে অভিষেক করানো হয়েছিলো তাঁর ছিঁটে ফোঁটাও অভিষেক ম্যাচে মিটাতে পারেনি। নিজের অভিষেক ম্যাচে মাত্র একটি ইনিংসেই তিনি বল করার সুশোগ পেয়েছিলেন যেখানে কি না ১৫০ রান দিয়েন নেন ১ উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১ম উইকেট হিসেবে ২০৬ রান করা রবি শাস্ত্রীকে ফেরান। অভিষেক ম্যাচে আলো ছড়াতে না পারলেও সময়ের বিবর্তনে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে রাজত্ব করে গেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকের পরের বছরই ২৪ শে মার্চ ১৯৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার অভিষেক হয়। তারপর থেকে নিজের পারফরম্যান্সের জন্য কখনো পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

বল হাতে জাদুকরঃ লেগস্পিনের জাদুকর হিসেবে ক্রিকেট মহারথে বেশ পরিচিত। বল হাতে তাঁর জাদুর শৈল্পিকতা স্মৃতির পাতায় বাধিঁয়ে রাখার মত যেখানে শুধুই সাফল্যের রুপকথা। সেই ১৯৯২ সালে অভিষেক আর ২০০৭ সালে বিদায়ের আগ পর্যন্ত সৃষ্টি করেছেন নানা রুপকথা। ১৯৯২ সালে টেস্টে অভিষেকটা দারুন না হলেও পরে আলো ছড়িয়েছেন নিজের মত করে। টেস্টে খেলেছেন ১৪৫ ম্যাচের ২৭৩ ইনিংসে বল করার সুযোগ হয়েছিলো তার। ২৭৩ ইনিংসে ৪০৭০৫ টি বল করে ১৭৯৯৫ টি রান দিয়ে ২৫.৪১ গড়ে নেন ৭০৮ টি উইকেট। ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ বোলিং ফিগার এক ইনিংসে ৭১ রানে ৮ উইকেট আর এক ম্যাচে নেন ১২৮ রানে ১২ উইকেট। ক্যারিয়ারে ১০ উইকেট নেন ১০ বার, ৫ উইকেট নেন ৩৭ বার আর ৪ উইকেট করে নেন ৪৮ বার। ওয়ানডে তে ১৯৪ ম্যাচের ১৯১ ইনিংসে ১০৬৪২ টি বল করে ৭৫৪১ রান দিয়ে ২৫.৭৩ গড়ে ও ৪.২৫ ইকনোমিতে নেন ২৯৩ উইকেট। সর্বোচ্চ বোলিং ফিগার ৩৩ রানে ৫ উইকেট আর ৫ উইকেট নেন ১ বার ৪ উইকেট নেন ১২ বার।

ব্যাট হাতে ওয়ার্নঃ একজন জেনুইন লেগস্পিনার হিসেবেই অজি দলে তার অন্তর্ভুক্তি তবে দলের প্রয়োজনে লোয়ার অর্ডারে ব্যাট হাতেও মোটামুটি ভালোই সামলাতে পারতেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে তার ব্যাটটা যেন একটু বেশিই সাবলীল। ১৪৫ ম্যাচের ১৯৯ ইনিংসে ব্যাট করে ৫৪৭০ টি বল মোকাবেলা করে ১৭.৩২ গড়ে করেন ৩১৫৪ রান। টেস্ট ক্যারিয়ারে শতক না থাকলেও রয়েছে ১২ টি হাফ-সেঞ্চুরি। তার ব্যাট থেকে আসে সর্বোচ্চ ৯৯ রাবের একটি ইনিংস সাথে চাররে মার ছিলো ৩৫৩ টি আর ছয়ের মার ছিলো ৩৭ টি। ক্যারিয়ারে ওয়ানডে খেলেছেন ১৯৪ টি ম্যাচ যেখানে ব্যাট করার সুযোগ হয়েছিলো ১০৭ ম্যাচে। ১০৭ ম্যাচে ১৪১৩ বল মোকাবেলা করে তার সংগ্রহ ১০১৮ রান। ফিফটি রয়োছে একটি, সর্বোচ্চ স্কোর ৫৫ সাথে চার মেরেছেন ৬০ টি আর ছক্কা মেরেছেন ১৩ টি।

অর্জনঃ ১৬ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অর্জন করেছেন অনেক কিছুই ছুঁয়েছেন নানাবিধ রেকর্ড। দেখে নেয়া যাক তাঁর কিছু অর্জন: ১. ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের অন্যতম সদস্য ২. ১ম ৬০০ উইকেট নেয়া বোলার। ৩. ১ম ৭০০ উইকেট নেয়া বোলার। ৪. সেমিফাইনাল ও ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় ৪. অ্যাশেজে মাইক গ্যাটিংকে করা বল টা বল অফ দ্যা সেঞ্চুরি হিসেবে স্বীকৃতি। ৫. ১৯৯৪ সালে উইজডনের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন ৬. ১৯৯৭ সালে জাতীয় পুরষ্কার জিতেন ৭. ২০০৪ সালে এক বছরে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেন।

বিতর্ক: ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তার সাফল্যের জন্য যেমন বেশ পরিচিত আর সম্মানিত তেমনি তার বিতর্কিত ইস্যুতেও বেশ আলোচিত । সবসময়ই কিছু না কিছুতে আলোচনায় আসতেন শেন ওয়ার্ন কখনো বান্ধুবী,কখনো নেশা,ক্যাসিনো এসবে। তিনি ধুমপানে খুবই আসক্ত ছিলো যেকারনে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাকা আলাদা টাকা দিতো নেশা ছাড়ার জন্য তবুও তিনি ছাড়তে পারেন নি। ২০০৩ সালে বিশ্বকাপের আগে ডোপ টেস্টের ফল পজেটিভ হওয়ায় বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি। এছাড়াও নানাবিধ বিতর্কে বিতর্কিত ছিলেন শেন ওয়ার্ন। ২০০৭ সালে অ্যাশেজ দিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানেন শেন ওয়ার্ন। ক্যারিয়ারে অনেকবার সমালোচিত হলেও তাঁর ক্রিকেট কীর্তির জন্য তিনি সারা জীবন প্রশংসনীয়। পাকিস্তানের লেগ স্পিনার আব্দুল কাদিরের পর ক্রিকেট বিশ্বে আলো ছড়ানোর মাঝে বিখ্যাত একজন তবে সর্বকালের সেরা লেগস্পিনার বললেও হয়তো ভুল হবে না। ক্রিকেটে তার যখন আসা তখন চলছিলো পেসারদের আধিপত্য তার মাঝেও নিজেকে গড়ে তুলেছেন বিশ্বসেরা বোলারে। পেস বোলিংয়ের দেশে একজন শেন ওয়ার্নের জন্ম সত্যিই অবাক করার মত। ক্রিকেটের মহারথ থেমে গেলেও হাজার বছর পরও হাজারও লেগস্পিনার স্বপ্ন বুনবেন একজন শেন ওয়ার্ন হওয়ার।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »