শুভ জন্মদিন শেন এডওয়ার্ড বন্ড!

কামরুল হাসান রাকিশ »

বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করা বোলারদের যদি সামনে নিয়ে আসা হয় কিংবা যাদের গতিময় বলের কাছে বিশ্বের সব বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান কুপোকাত হয়েছেন। এমন হিসাব করলে সবার আগে ওয়াকার ইউনুস, ওয়াসিম আকরাম, শোয়েব আকতার, ব্রেট লি, কিংবা স্টেইনদের নাম উচ্চারণ করতে হবে। তবে আরও একটি নাম এই সারিতে মনের অকপটে চলে আসবে তা হলো কিউই ডানহাতি পেসার, নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের গতির অনন্য নিদর্শন, কিউই গতির রাজা কিংবা সুয়িং কিং, ১.৭৫ মিটারের সুদীর্ঘকায় ব্যাক্তি “শেন এডওয়ার্ড বন্ড” শেন বন্ড জন্মেছিলেন ১৯৭৫ সালের আজকের এই দিনে ৭ই জুন। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ, ক্যান্টারবারি শহরে, বয়স আজকের দিনে ৪৫ বছরে পা দিলেন। যার ক্যারিয়ারের শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে স্থানীয় দল “ক্যান্টারবারি” ক্লাবের হয়ে।

ফাস্ট, ফিউরিয়াস, ড্যাশিং! এককথায় শেন বন্ডের বর্ণনা দিতে এই তিনটি বিশেষণই যথেষ্ট। রূপালি পর্দায় জেমস বন্ড যেভাবে কৌশলে তার শত্রুদের ধরাশায়ী করেন, ক্রিকেট মাঠে শেন বন্ড ঠিক সেভাবেই আগুনঝরা ফাস্ট বোলিংয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের কুপোকাত করতেন। স্পেশাল এজেন্ট বন্ডের মারদাঙ্গা সিনেমার মতই অ্যাকশনে ভরপুর ছিল নিউজিল্যান্ডের স্পিডস্টার বন্ডের ক্যারিয়ার। কিন্তু তার ক্যারিয়ারের সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ঘাতক ‘ইনজুরি’। ইনজুরি বাধায় ক্যারিয়ারে বার বার ছন্দপতন না ঘটলে হয়ত ক্রিকেট ইতিহাসের ‘সর্বকালের সেরা’ ফাস্ট বোলারদের একজন হতে পারতেন তিনি।

বন্ড ছিলেন রিচার্ড হ্যাডলি পরবর্তী যুগে নিউজিল্যান্ডের অবিসংবাদিত সেরা ও সফলতম ফাস্ট বোলার, একজন ভয়ঙ্কর জাত উইকেটশিকারি। তাঁর আক্রমণাত্মক শারীরিক ভাষা এবং হার না মানা লড়াকু মানসিকতা তাঁকে সবসময় প্রতিপক্ষের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে রাখত। যেকোন উইকেটে গতির ঝড় তুলে ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপন ধরাতে পারতেন বন্ড।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ঘন্টায় ১৪৫ কিমি গতিতে নিয়মিত বোলিং করতেন বন্ড। ২০০১-০২ মৌসুমে তিনি প্রথমবারের মত ঘন্টায় ১৫০ কিমির চেয়ে বেশি গতিতে বল করার রেকর্ড গড়েছিলেন। তাঁর সবচাইতে বেশি গতির বল ছিল ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ঘন্টায় ১৫৬.৪ কিমি। বন্ডের শুধু দুরন্ত গতিই ছিল না, সাথে ছিল দারুণ অ্যাকুরেসি ও কন্ট্রোল।

ক্যারিয়ার ছোট হলেও টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই দারুণ সফল ছিলেন ‘ইনজুরিপ্রবণ’ এই ফাস্ট বোলার। পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই অবিশ্বাস্য রকমের ধারাবাহিক বন্ডের টেস্ট অভিষেক ২০০১-০২ মৌসুমে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। তবে অভিষেকের পর থেকে নয় বছরে মাত্র ১৮ টি টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছেন তিনি! যেটা তাঁর ক্যালিবারের একজন বোলারের জন্য একই সাথে হতাশা এবং আক্ষেপের। ১৮ টেস্টে ৩২ ইনিংসে মাত্র ২২.০৯ গড়ে আর ৩৮.৭ স্ট্রাইক রেটে বন্ডের উইকেটসংখ্যা ৮৭টি। টেস্ট ইতিহাসে ন্যুনতম ২৫০০ বল করা বোলারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেটটাও (৩৮.৭) তাঁর দখলে। মাত্র ৩৪.১ স্ট্রাইক রেট নিয়ে এক নম্বরে আছেন উনিশ শতকের কিংবদন্তি মিডিয়াম পেসার জর্জ লোহম্যান।

ওয়ানডে ফরম্যাটে বন্ডের সাফল্যের পাল্লা আরো ভারি। ৮২ ওয়ানডেতে ৮০ ইনিংসে বল হাতে নিয়ে মাত্র ২০.৮৮ গড়ে এবং ২৯.২ স্ট্রাইক রেটে তাঁর শিকার ১৪৭ উইকেট। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অন্তত ৩০০০ বল করেছেন এমন বোলারদের মধ্যে চতুর্থ সেরা বোলিং গড় এবং তৃতীয় সেরা স্ট্রাইক রেট বন্ডের।

নিউজিল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডেতে দ্রুততম ১০০ উইকেটের (৫৪ ম্যাচ) রেকর্ডটিও বন্ডের দখলে।

বন্ডের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলা যায়, ২০০১-০২ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় ওয়ানডে টুর্নামেন্ট ‘ভিবি সিরিজ’কে। গোটা সিরিজ জুড়েই অসাধারণ বোলিং করা বন্ড ৮ ম্যাচে মাত্র ১৬.৩৮ গড়ে ২১ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন সিরিজ সেরা। অথচ ওটাই ছিল বন্ডের অভিষেক সিরিজ!

২০০৩ বিশ্বকাপটা ছিল বন্ডের ক্যারিয়ারের সবচাইতে স্মরণীয় ও উজ্জ্বলতম অধ্যায়। পুরো টুর্নামেন্টেই তিনি ছিলেন দারুণ ধারাবাহিক। ৮ ম্যাচে মাত্র ১৭.৯৪ গড়ে নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট; হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের ৫ম সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। এছাড়া ২০০৭ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের সেমিফাইনালে ওঠার পেছনেও ‘উইকেট শিকারি’ বোলার হিসেবে বন্ডের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপ মিলিয়ে ১৬ ম্যাচে মাত্র ১৭.২৩ গড়ে বন্ডের শিকার ৩০ উইকেট। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বকাপে বন্ডের ইকোনমি রেট মাত্র ৩.৫১! যা একজন ফাস্ট বোলারের জন্য রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার! খেলোয়াড়ি জীবনে সাফলতার পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা শব্দটাও তাঁর জীবনে এসেছিল, কথায় আছে “যে আলোচিত সেই সমালোচিত” সেই ধারাবাহিকতায় মার্চ ২০০৮ সালে, নিষিদ্ধ ক্রিকেট লীগ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লীগে (আইসিএল) দিল্লি জায়েন্টস দলে অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপটে তাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে ১৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়। জানুয়ারি, ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড তার সাথে চুক্তি স্থগিত করে। জুন, ২০০৯ সালে বিদ্রোহী প্রতিযোগিতা থেকে নিজ নাম প্রত্যাহার করায় তাকে পুণরায় জাতীয় দলে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। জানুয়ারি, ২০১০ সালে আইপিএলের ৩য় মৌসুমে কলকাতা নাইট রাইডার্স দলের সাথে চুক্তিতে উপনীত হন। ১৩ মে, ২০১০ তারিখে সকল স্তরের ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করায় তিনি আইপিএলের চতুর্থ আসরে অংশগ্রহণ করেননি।
২০০৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হোম সিরিজে শেষবারের মত জাতীয় দলে ডাক পান বন্ড। সেই সিরিজেই খেলেছিলেন টেস্ট ক্যারিয়ারের বিদায়ী ম্যাচ। ডানেডিনে অনুষ্ঠিত সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১০৭ রানে পাঁচটি ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৬ রানে তিন উইকেট নিয়ে “ম্যাচ সেরা” হয়ে বিদায় বেলাটাকেও রাঙিয়ে গিয়েছিলেন বন্ড।

ডিসেম্বর, ২০০৯ সালে দীর্ঘদিন যাবৎ আঘাতপ্রাপ্তির কারণে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। তবে তিনি সীমিত ওভারে অংশগ্রহণের কথা জানান। ১৮ টেস্টে ২২.০৯ রান গড়ে ও ৩৮.৭ স্ট্রাইক রেটে তিনি ৮৭ উইকেট লাভ করেন। ১৪ মে, ২০১০ তারিখ টুয়েন্টি২০ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে আকস্মিক ভাবে অবসরের ঘোষণা দেন।

এর প্রধান কারণ ছিল ২০১০ সালের আইসিসি বিশ্ব টোয়েন্টি২০ প্রতিযোগিতার সেমি-ফাইনালে নিউজিল্যান্ড দল উন্নীত হতে পারেনি। অবসর নিলেও যে মানুষ ক্যারিয়ারের সবটা সময় ক্রিকেট কে লালন করেছেন তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন, ইঞ্জুরি যাকে শেষ করে দিয়েছিল, সেই লোকটি ক্রিকেট কে ছেড়ে যাননি, অবসরের পর কোচিং জীবনে ফিরেছিলেন, ২০১০ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটের এইচআরভি ও চ্যাম্পিয়ন্স লীগে সেন্ট্রাল স্ট্যাগস দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করেন। অক্টোবর, ২০১২ সাল থেকে তাকে নিউজিল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলের বোলিং কোচের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু, ২০১৫ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে নিউজিল্যান্ড দল খেললেও এ পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। এ তিন বছরে ট্রেন্ট বোল্ট ও টিম সাউদি’র ন্যায় বোলার তৈরির ক্ষেত্রে তার অবদান প্রশংসনীয়। ২০১৫ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বোলিং কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি।

যার এতে বর্ণিল ক্যারিয়ার সেই ব্যক্তিকে ক্রিকেট কিছু দিবে না তা কি হয়। সম্মাননা হিসেবে শেন বন্ড পেয়েছিলেন সর্বকালের সেরা নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট একাদশে অন্তর্ভুক্তের সুযোগ। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের “সর্বকালের সেরা একাদশের” একজন গর্বিত সদস্য শেন বন্ড। শ্রেষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, শেন বন্ড ছিলেন সবচাইতে ভয়ংকর, আগ্রাসী ও বিস্ফোরক ফাস্ট বোলারদের একজন। ছন্দে থাকা বন্ড পৃথিবীর যেকোন ব্যাটসম্যানের জন্য ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। যখন শুনি ম্যাথু হেইডেনের মত কেউ নাকি বন্ডের তীব্র গতির ‘টো ক্রাশিং’ ইয়র্কারের হাত থেকে পা বাঁচাতে বুটের ওপর ‘টো-গার্ড’ লাগিয়ে খেলতে নামতেন, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে ব্যাটসম্যানদের মনে ঠিক কতটুকু ভীতির সঞ্চার করতে পেরেছিলেন তিনি। বন্ডকে নিয়ে বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় একটি উক্তি “নিউজিল্যান্ডের কাছে তিনি তাঁদের নতুন রিচার্ড হ্যাডলি, বাকি দুনিয়ার কাছে তিনি বন্ড, শেন বন্ড!”

শুভ জন্মদিন মিস্টার জেমস, শেন এডওয়ার্ড বন্ড।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »