ম্যাচ না খেললে মানসিকভাবে পিছিয়ে যাবে ক্রিকেটাররা: হান্নান সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক »

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সম্ভবনাময়ী এবজন ব্যাটসম্যান ছিলেন হান্নান সরকার। ২০০২ সালে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয় এই ডাহাতি ব্যাটসম্যানের। তবে বেশি দিন স্হায়ী হয় নি তার ক্যারিয়ার। আড়াই বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে করেছেন ১০৪৫ রান। অর্ধশতক রয়েছে ৮টি।

তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও জড়িয়ে রয়েছেন ক্রিকেটর সঙ্গেই। বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) বয়সভিত্তক দলের নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলটি নির্বাচন করেছেন তিনি।

করোনার এই কঠিন সময়ে অনেকেটাই ঘরবন্দি হয়ে সময় কাটাচ্ছেন বাংলাদেশ দলের সাবেক এই ক্রিকেটার। বর্তমানে ব্যাটসম্যানদের মাঝে কি ধরণের সমস্যা রয়েছে সেটা এবং কিভাবে সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা যাবে সেটা নিয়ে খোলামেলা ভাবে কথা বলেছেন নিউজক্রিকেট২৪ এর সঙ্গে। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

 

নিউজক্রিকেট২৪: আপনার চোখে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দূর্বলতা কোথায়?

 

 হান্নান সরকার: আসলে কি এখন যদি আমাদের ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা জায়গা কথা বলি টেকনিক্যালি যে খুব বেশি দুর্বল সেটা আমি মানতে চাই না। মূলত আমাদের কিছু কিছু জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে সেটা হলো আমাদের কোয়ালিটি বলার ফেস করার ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে। যেমন আমরা যখন আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলি সেখানে ১৪০-৪৫ গতির বোলার খেলি কিন্তু খুব কম। আমরা জানি আমাদের ১৪০-৪৫ গতির বোলার খুব কম। তাদেরকে ফেস করার পরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে যদিও এ ধরনের বলার ফেস করি তখন আমাদের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একটা দুর্বলতা প্রকাশ পায়।

 

নিউজক্রিকট২৪: এই সমস্যা কি জন্য তৈরি হচ্ছে?

 

হান্নান সরকার: আমি যখন ১৪৫ গতির বল খেলবো তখন আমার কাছে ১৩৫ গতিটা সহজ মনে হবে। কিন্তু আমি যদি ১৩৫-৪০ খেলে আমি যখন ১৪৫ গতির বল খেলতে যাব তখন সেখানে আমার একটা নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। এজন্য আমাদের ব্যাটসম্যানদের অনেক সময় বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আর একটা ব্যাপার হল আমাদের ন্যাশনাল টিমের প্লেয়ার যারা যারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে তারা অনেক সময় ঘরোয়া ক্রিকেটে যে উইকেটে খেলছে বা যেখানে পারফর্ম করেন সেই জায়গাটা কিন্তু সেই ধরনের সুইং কিংবা পেসের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। যে জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যখন সুইং বা ওই ধরনের কোয়ালিটি বোলারদের ফেস করতে হচ্ছে তখন একটা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে বা চ্যালেঞ্জ আমাদের নিতে হচ্ছে।

 

নিউজক্রিকেট২৪: যারা জাতীয় দলের তরুণ ক্রিকেটার আছে তাদের কি বেশি বেশি ‘এ’ টিম কিংবা এইচপি দলের সঙ্গে দেশের বাইরে সিরিজ খেলালে সমস্যার সমাধান হতে পারে?

 

হান্নান সরকার: খুবই সম্ভব কারণ যদি আমি সম্প্রতি একটা পারফরম্যান্স দেখি সেটা হল অনূর্ধ্ব-১৯ দল। গত দেড় বছরে আমরা ইংল্যান্ড ট্যুর করেছি ম্যাচ খেলেছি, নিউজিল্যান্ডে ম্যাচ খেলেছি, শ্রীলঙ্কায় ম্যাচ খেলেছি। ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের ওই কন্ডিশনে ম্যাচ খেলার যে অভিজ্ঞতা তার ফল কিন্তু ওয়ার্ল্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন। ওই ধরনের কন্ডিশনে যত বেশি খেলা হবে, চ্যালেঞ্জ যত বেশি নেওয়া হবে ততই কিন্তু প্লেয়ারদের মানসিকতার উন্নতি হবে। পাশাপাশি নিজের আত্মবিশ্বাস এর লেভেলটাও বাড়বে এবং ওই কন্ডিশনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও বাড়বে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই যত বেশি এই ধরনের কন্ডিশনে খেলা যায় অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায় তার ফল কিন্তু ইতিবাচক হিসেবে পাওয়া শুরু করবে। সেক্ষেত্রে আমাদের ‘এ’ টিম, এইচপি টিম বা পরবর্তীতে যারা আসবেন, ন্যাশনাল টিমের পরের ধাপে তাদেরকে এই ট্যুর গুলোর মাধ্যমে যদি প্রস্তুত করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তারা কিন্তু কখনোই নতুন কিছু মনে হবে না। মনে হবে যে আমারও তো এগুলো অনুশীলন করে এসেছি। এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের ক্রিকেট বোর্ড কিন্তু সেটা চেষ্টা করছে।

 

 

নিউজক্রিকেট২৪: প্রতিপক্ষে হিসেবে কি সবসময় ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো অন্যান্য দেশের কাছ থেকে কেমন সাড়া পাওয়া যায়?

 

হান্নান সরকার: এক্ষেত্রে কিন্তু অনেক সময় সম্যায় পড়তে হয়। ধরেন, এখন আমরা ইংল্যান্ড ট্যুরে যেতে চাই সেক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের কাছ থেকেও কিন্তু পজিটিভ রেসপন্স আসা লাগবে। অনেক সময় কিন্তু পজিটিভ রেসপন্স করে না। এই দিক দিয়ে কিন্তু আমাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় প্রস্তাব দেওয়া হয় কিন্তু সেভাবে উত্তর অনেক সময় আসে. অনেক সময় আসে না। সেজন্য বাধার সম্মুখীন হতে হয় সে। আমাদের যত বেশি বাহিরে খেলা যায় বাংলাদেশ টিমের পারফরম্যান্স উন্নতি হবে।

 

নিউজক্রিকেট২৪: আমাদের ক্রিকেট মৌসুমটা কি আরও আগে শুরু করা যায়?

 

হান্নান সরকার: আমাদের আমাদের মৌসুমটা কিন্তু শুরু হয় সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবরের দিকে কিংবা সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। আমাদের দেশে কিন্তু শীতকাল শুরু হয় তার কিছু আগে বর্ষার কিন্তু একটা বিষয় রয়েছে সে ক্ষেত্রে মাঠ প্রস্তুত করার জন্য গ্রাউন্ডসম্যানদের সময় দিতে হয়। প্লেয়ারদের নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে সময় দিতে হয়। সবকিছু মিলে সিজনটা যখন শুরু হয় তখন কিন্তু ভালো সময় শুরু হয়।

 

 

নিউজক্রিকেট২৪: আমাদের কেমন উইকেটে অনুশীল করা উচিৎ কিংবা অনুশীলন করছি?

 

হান্নান সরকার: আমাদের মিরপুরে ইনডোর স্টেডিয়ামের পাশে কিন্তু একটা উইকেট আছে, ওই উইকেটটা কিন্তু কাউকেই ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। এখানে শুধু ন্যাশনাল থেকে প্লেয়াররা করে। আমরা অনূর্ধ্ব-১৯ দল যখন ইংল্যান্ডে গেলাম, আমরা উইকেটটা সাতদিনের জন্য পেয়েছিলাম। এটা অন্যদের দেওয়া হয়নি এটা জাতীয় দলের প্লেয়ারদের জন্য এতটাই প্রস্তুত রাখা হয় এবং সেইভাবে মেনটেন করা হয়। এই উইকেটে কিন্তু কয়েকটা ভিন্ন উইকেট রয়েছে যেই উইকেটের ক্যাটাগরিটা একটু ভিন্ন,  বাউন্স থাকে সেখানে। এখানে কিন্তু একটা পরিবেশের ব্যাপার রয়েছে ঠান্ডা পরিবেশ হলে বলের মুভমেন্টটা ভালো হবে উইকেটটা একটু স্যাতস্যাতে হবে মানে কিছু একটা ব্যাপার কাজ করে। এই কন্ডিশনটা কিন্তু আমরা আসলে বানাতে পারি না। আমরা এখানেই উইকেট এর প্রিপারেশন ঠিকই নিতে পারছি কিন্তু যেখানে খেলতে যাব সেখানকার ওয়েদার কন্ডিশন  সেখানকার ওয়েদারের জন্য একটা এক্সট্রা মুভমেন্ট বা একটা স্যাতস্যাতে ভাব, এটা কিন্তু আমরা তৈরি করতে পারছিনা।

 

নিউজক্রিকেট২৪: এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনার কাছে কি মনে হয় আমাদের কিনা তিন ফরম্যাটের জন্য আলাদা স্পেশাল ব্যাটসম্যান তৈরির সময় হয়েছ?

 

হান্নান সরকার: সেটা অবশ্যই ভাববার সময় এসেছে এবং সেটা যে ভাবা হচ্ছে। তার ফল হচ্ছে আমরা কিন্তু দেখছি যে আমরা কিছু কিছু প্লেয়ারকে টি-টোয়েন্টিতে দেখছি, কেউ ওয়ানডেতে, কেউ টেস্টে। আমাদের টেস্ট ক্যাপ্টেন মুমিনুরকে কিন্তু শুধু টেস্ট ফরমেটে খেলানো হচ্ছে। সাদমান ইসলাম, সাইফ হাসান এদেরকে নিয়ে টেস্টের জন্য চিন্তা করা হচ্ছে। এই তিনজনের নাম বললাম কিন্তু এরকম কিন্তু স্পেশালাইজড ব্যাটসম্যান আছে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের এর জন্য নাঈম শেখ কে চিন্তা করা হচ্ছে, আফিফকে কিন্তু টি-টোয়েন্টির জন্য চিন্তা করা হচ্ছে। বোর্ড কিন্তু চিন্তা করা শুরু করেছে যে আমরা ভিন্ন ভিন্ন ফরমেটে ভিন্ন ভিন্ন ক্রিকেটার তৈরি করব।

 

নিউজক্রিকেট২৪: ক্রিকটারদের মানসিকভাবে আরও কতটুকু প্রস্তুত হওয়া উচিৎ?

 

হান্নান সরকার: আমাদের দেশের ক্রিকেটারের কিন্তু স্কিল ভালো। স্কিল ভালো না থাকলে কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারত না। মেন্টালি কিন্তু তাদের ওই লেভেলটা থেকে। কে কত পরিপক্ক, কে কতটা শক্ত, কে কতটা পরিস্থিতি কন্ট্রোল করতে পারে এই জিনিসগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা কিন্তু সত্যি যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটের মানসিকতা দিক দিয়ে অনেক ক্রিকেটার থেকে পিছিয়ে আছি আমরা। তবে এখন কিন্তু কনফিডেন্স রেভেল আস্তে আস্তে বাড়ছে। সম্প্রতি দেখেন লিটন-সৌম্য কিন্তু ভালো খেলছে। লিটন কিন্তু এখন ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলছে যেটা আগে তার মধ্যে দেখা যায়নি। আমাদের পরবর্তী জেনারেশন যারা মানসিকভাবে তৈরি এখন, তারা অবশ্যই স্ট্রং আছে। তা না হলে তো বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারাতে পারত না। তারা কিন্তু মেন্টালি স্ট্রং হয়ে আরো উপরে উঠছে। আমি এটা নিশ্চিত যে সবাই এটা অনুভব করতে শুরু করেছে যে মেন্টাল স্ট্রং হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্য কিন্তু বেড়ে যাবে সেই জায়গা থেকে তারা অবশ্যই কাজ করছে এবং সেটা উন্নত হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে।

 

 

নিউজক্রিকেট২৪: তাহলে কি আপনার কাছে মনে হয় না যে বর্তমান পরস্থিতিতে কোয়ারেন্টিনে থেকে ক্রিকেটারদের মানসিকভাবে ঘাটতির তৈরি হচ্ছে?

 

হান্নান সরকার: এই বিষয়টা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ মানসিকভাবে তারা কিন্তু মাঠে ক্রিকেট খেলছেন না। আমরা জানি যে মাঠে ক্রিকেট না খেললে আমাদের মধ্যে একটা মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। আমরা সব সময় বলি যে যত বেশি ম্যাচ খেলবে আরো বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, সেই জায়গা থেকে কিন্তু তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। এই জায়গাটা মানসিকভাবে গ্যাপ তৈরি হচ্ছে।

 

 

নিউজিক্রিকেট২৪: এটা থেকে বের হয়ে আসার কোনো উপায় আছে কি?

 

হান্নান সরকার: এক্ষেত্রে আমরা মানসিক কিছু সেশন আমরা দেখে থাকি নেটে বিভিন্ন জায়গায়। এটা কিন্তু তারা করতে পারে তাদের উন্নতির জন্য।

 

 

নিউজক্রিকেট২৪: আপনাকে অসংখ্যা ধন্যবাদ আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য।

 

হান্নান সরকার: আপনাকেও ধন্যবাদ।

 

বাংলাদেশ সময়: ০৫:৪৫ এএম

নিউজক্রিকেট২৪/এসএমএস

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »