গাজী নাসিফুল হাসান »
ক্রিকেটের সর্বোচ্চ জনপ্রিয় ও শীর্ষ টুর্নামেন্ট হচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ১৯৭৫ সাল থেকে প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর এই ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট হচ্ছে এই আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ। যেটি ওয়ানডে ফরম্যাটে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বকাপের মাধ্যমে প্রতি চার বছরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নির্ধারণ করা হয়। পরের বিশ্বকাপ শুরু হবার আগ পর্যন্ত একটি দল যে আগের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো সে নিজেকে চ্যাম্পিয়ন দাবি করে থাকে। পরেরবার আবারো শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়ে জায়গা করে নিতে হয়। এটি মূলত ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লড়াই। আজ আপনাদের এই ক্রিকেট বিশ্বকাপের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করবো।
১৯৭৫ সালে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরু হয়। প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ইংল্যান্ডে এবং প্রথম বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ। এই ক্রিকেট বিশ্বকাপের সর্বশেষ আসর অর্থাৎ, ১২ তম আসর অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডে এবং ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে ইংল্যান্ড। ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বাধিক পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে অষ্ট্রেলিয়া, দুইবার করে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত ও ওয়েষ্ট ইন্ডিজ এবং একবার করে চ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড। ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রানার্স আপ হয়েছে ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ড মোট তিনবার রানার্স আপ হয়েছে। যা বিশ্বকাপে সর্বাধিক রানার্স আপের রেকর্ড। এছাড়াও ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বাধিক সফল দল হচ্ছে অষ্ট্রেলিয়া শুধু শিরোপা জয়ের হিসাবে নয় বরং জয়ের হিসাবেও এগিয়ে অষ্ট্রেলিয়া। অষ্ট্রেলিয়া সর্বমোট ৬৯টি ম্যাচ জয় পেয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপে অজিদের জয়ের শতকরা হার হচ্ছে: ৭৪.৭৩%।
বিশ্বকাপ ট্রফি ও তার ইতিহাস:
বর্তমানে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের যে ট্রফি দেয়া হয় সেটিকে বলা হয় আইসিসি বিশ্বকাপ ট্রফি। এটি মূলত ক্রিকেট বিশ্বকাপে প্রথম স্থায়ী কোনো ট্রফি। এট ১৯৯৯ বিশ্বকাপ থেকে প্রদান করা শুরু হয়েছিলো। এর আগ পর্যন্ত স্থায়ী কোনো ট্রফি ছিলো না। প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফির নাম ছিলো প্রুডেন্সিয়াল কাপ ট্রফি। এটি ১৯৮৩ বিশ্বকাপ পর্যন্ত বলবৎ ছিলো। প্রুডেনশিয়াল প্রাইভেট লিমিটেড কো: ব্যবসায়ের অংশীদার পরিবর্তন করার ফলে প্রুডেন্সিমাল কোম্পানি সরে আসে। পরে ১৯৮৭ বিশ্বকাপে রিলায়েন্স কোম্পানি কর্তৃক রিলায়েন্স বিশ্বকাপ ট্রফি, ১৯৯২ সালে বেনসন এন্ড হেজেস কর্তৃক বেনসন এন্ড হেজেস কাপ ট্রফি এবং ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে আইটিসি ব্র্যান্ড কর্তৃক উইলস বিশ্বকাপ ট্রফি নাম করা হয়। তবে পরবর্তীতে আইসিসি এটিকে স্থায়ী পুরষ্কার হিসেবে করতে আগ্রহী হয়। বর্তমানে যে আইসিসি ট্রফি রয়েছে সেটি দুই মাস সময় লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বর্তমান যে ট্রফি রয়েছে সেটি প্রস্তুতকারক ও নকশাকার প্রতিষ্ঠান ছিলো লন্ডনের গারার্ড এন্ড কোং। এই ট্রফিটি রৌপ্য ও সোনালী রং এর তৈরি। ১৯৯৯ এর আগের বিশ্বকাপ জয়ী সহ নাম ট্রফিটিতে খোদাই করা আছে। এতে সর্বমোট ২০টি নাম খোদাই করা যাবে। মূল ট্রফিটি আইসিসি তাদের কাছে রেখে দিয়েছে সংরক্ষণ করে। আর বিজয়ী দলকে বিকল্প একটি ট্রফি স্থায়ীভাবে প্রদান করা হয়ে থাকে। আইসিসি কর্তৃক তৈরিকৃত প্রথম ট্রফি জিতেছিলো অষ্ট্রেলিয়া। অষ্ট্রেলিয়া সর্বোচ্চ চারবার এই ট্রফি জেতার রেকর্ড গড়েছে।
বিশ্বকাপে সবগুলো আসরে খেলা দল:
আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে মোট ১২ বার। ১২ বারের ১২ বারেই অংশ নিয়েছে এমন দল সংখ্যা হচ্ছে ৭টি। দলগুলো হলো: অষ্ট্রেলিয়া, ভারত, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড। ১৯৭৫-২০১৯ পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় সবগুলো বিশ্বকাপগুলোতে খেলেছে এই সাতটি দল।
বিশ্বকাপে অভিষিক্ত দল:
১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপে অনুষ্ঠিত হয়। সে বিশ্বকাপে মোট ৮টি দল খেলে। এই ৮টি দলেরই বিশ্বকাপে প্রথম অভিষেক হয়। দলগুলো হলো: অষ্ট্রেলিয়া, ভারত, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড, পূর্ব আফ্রিকা ( কেনিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, জাম্বিয়াকে নিয়ে সেসময়কার গঠিত আফ্রিকা দল )।
১৯৭৯ সালে অভিষেক হয়: কানাডার।
১৯৮৩ সালে অভিষেক হয়: জিম্বাবুয়ে।
১৯৮৭ সালে কারো অভিষেক হয় নি।
১৯৯২ সালে অভিষেক হয়: দক্ষিণ আফ্রিকার।
১৯৯৬ সালে অভিষেক হয়: কেনিয়া, নেদারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
১৯৯৯ সালে অভিষেক হয়: বাংলাদেশ ও স্কটল্যান্ড।
২০০৩ সালে অভিষেক হয়: নামিবিয়ার।
২০০৭ সালে অভিষেক হয়: বারমুডা ও আয়ারল্যান্ড।
২০১১ সালে কারো অভিষেক হয় নি।
২০১৫ সালে অভিষেক হয়: আফগানিস্তানের।
২০১৯ সালে কারো অভিষেক হয় নি।
বিশ্বকাপে টুর্নামেন্টে সেরাদের তালিকা:
মূলত ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ থেকে বিশ্বকাপে একজন খেলোয়াড়কে টুর্নামেন্টে সেরা ঘোষণা করতে থাকে। নিচে ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টুর্নামেন্টে সেরাদের তালিকা ও তাদের পারফরম্যান্স দেয়া হলো:
১৯৯২: মার্টিন ক্রোউই ( নিউজিল্যান্ড )- ৪৫৬ রান।
১৯৯৬: সনাত জয়াসুরিয়া ( শ্রীলঙ্কা )- ২২১ রান ও ৭ উইকেট।
১৯৯৯: ল্যান্স ক্লুসনার ( দক্ষিণ আফ্রিকা )- ২৮১ রান ও ১৭ উইকেট।
২০০৩: শচীন টেন্ডুলকার ( ভারত )- ৬৭৩ রান ও ২ উইকেট।
২০০৭: গ্লেন ম্যাকগ্রা ( অষ্ট্রেলিয়া )- ২৬ উইকেট
২০১১: যুবরাজ সিং ( ভারত )- ৩৬২ রান ও ১৫ উইকেট।
২০১৫: মিচেল স্টার্ক ( অষ্ট্রেলিয়া )- ২২ উইকেট।
২০১৯: কেইন উইলিয়ামসন ( নি্তসউজিল্যান্ড )- ৫৭৮ রান ও ২ উইকেট।
বিশ্বকাপ ফাইনালে ম্যাচ সেরা:
১৯৭৫: ক্লাইভ লয়েড ( ওয়েষ্ট ইন্ডিজ )- ১০২ রান।
১৯৭৯: ভিভ রিচার্ডস ( ওয়েষ্ট ইন্ডিজ )- ১৩৮ রান।
১৯৮৩: মহিন্দার অমরনাথ ( ভারত )- ৩ উইকেট ও ২৬ রান।
১৯৮৭: ডেভিড বুন ( অষ্ট্রেলিয়া )- ৭৫ রান।
১৯৯২: ওয়াসিম আকরাম ( পাকিস্তান )- ৩৩ রান ও ৩ উইকেট।
১৯৯৬: অরবিন্দ ডি সিলভা ( শ্রীলঙ্কা )- ১০৮ রান ও ৩ উইকেট।
১৯৯৯: শেন ওয়ার্ন ( অষ্ট্রেলিয়া )- ৪ উইকেট।
২০০৩: রিকি পন্টিং ( অষ্ট্রেলিয়া )- ১৪০ রান।
২০০৭: অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ( অষ্ট্রেলিয়া )- ১৪৯ রান।
২০১১: মহেন্দ্র সিং ধোনি ( ভারত )- ৯১ রান।
২০১৫: জেমস ফকনার ( অষ্ট্রেলিয়া )- ৩ উইকেট।
২০১৯: বেন স্টোকস ( ইংল্যান্ড )- ৮৪ রান।
বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সংগ্রহ:
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহের রেকর্ড অষ্ট্রেলিয়ায়। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে অষ্ট্রেলিয়া ৬ উইকেটের বিনিময়ে ৪১৭ রান করার রেকর্ড গড়েন।
বিশ্বকাপের সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহ হচ্ছে কানাডার+ ৩৬ রান। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৩৬ রানে অলআউট হয়ে যায় কানাডা।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক:
শচীন টেন্ডুলকার: ৪৫ ম্যাচে ৫৬.৯৫ গড়ে ২২৭৮ রান ( শচীন টেন্ডুলকার ১৯৯২-২০১১ সাল অবধি ৬টি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন )।
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ:
মার্টিন গাপ্টিল: ১৬৩ বলে ২৩৭ রান, ২৪টি চার ও ১১টি ছক্কা, ওয়েষ্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে।
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি:
রোহিত শর্মা ও শচীন টেন্ডুলকার ( ভারত )- উভয়েই ৬টি করে সেঞ্চুরি করেছেন।
এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি:
রোহিত শর্মা ( ভারত )- ৫টি ( ২০১৯ আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে )
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ডাক:
নাথান অ্যাশলে ও ইজাজ আহমেদ- দুজনেই ৫ বার করে ডাক মেরেছেন।
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলার:
গ্লেন ম্যাকগ্রা ( অষ্ট্রেলিয়া ): ৩৯ ম্যাচ খেলে ১২৯২ রান দিয়ে ৭১টি উইকেট নিয়েছেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। সেরা বোলিং ফিগার ৭/১৫। ৫ উইকেট নিয়েছেন: ২ বার।
বিশ্বকাপে সেরা বোলিং ফিগার:
গ্লেন ম্যাকগ্রা ( অষ্ট্রেলিয়া )- ৭ ওভার বোলিং করে ১৫ রানের বিনিময়ে ৭টি উইকেট নিয়েছেন নামিবিয়ার বিপক্ষে।
সর্বোচ্চ ইকোনমিকাল বোলার:
অ্যান্ড্রি রবার্টস ( ওয়েষ্ট ইন্ডিজ )- ৩.২৪।
এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি:
মিচেল স্টার্ক ( অষ্ট্রেলিয়া )- ২৭ উইকেট ( ২০১৯ আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে )।
সর্বোচ্চ গতিময় বোলিং:
১৬১.৩ কিলোমিটার ( ২০০৩ )।
বিশ্বকাপে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ৫ উইকেট প্রাপ্তি:
মিচেল স্টার্ক ( অষ্ট্রেলিয়া )- ৩ বার।
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ডিসমিশাল:
কুমার সাঙ্গাকারা ( শ্রীলঙ্কা )- ৩৭ ম্যাচে ৫৪ ডিসমিশাল। ৪১টি ক্যাচ ও ১৩টি স্ট্যাম্পিং।
বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ডিসমিশাল:
রিকি পন্টিং ( অষ্ট্রেলিয়া )- ৪৬ ম্যাচে ২৮টি ক্যাচ।
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ক্রিকেটার:
রিকি পন্টিং ( অষ্ট্রেলিয়া )- ৪৬টি।
বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ক্রিকেটার:
রিকি পন্টিং ( অষ্ট্রেলিয়া )- ২৯ ম্যাচ ( ২০০৩-২০১১ বিশ্বকাপ )
বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ আম্পায়ারিং করা আম্পায়ার:
ডেভিড রবার্ট শেফার্ড- ৪৬ ম্যাচ ( ১৯৮৩-২০০৩)