দুর্জয় দাশ গুপ্ত, সিলেট থেকে »
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বেজে উঠলো বিদায়ের এক করুণ সুর। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অধিনায়কের বিদায় মঞ্চ ঠিক যেমনটা হওয়ার কথা তেমনই হলো। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেই একটা লাল সবুজের দুই নম্বর এগারোটাতে পরিণত হলো। ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে ব্রায়ান লারাদের মত কিংবদন্তিদের বিদায় দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। তবে একজন অধিনায়কের বিদায় কি এভাবে এর আগে কেউ দেখেছে?
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচটির মধ্যে দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেট হারিয়েছে অন্যতম সেরা একজন অধিনায়ককে। লাক্কাতুড়ার নয়নাভিরাম এই স্টেডিয়ামে বিদায় নিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের দিন বদলের কান্ডারি মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা। তবে এই বিদায়টা একেবারে ক্রিকেট থেকে নয়। বিদায় নিলেন কেবল গুরুদায়িত্ব তথা অধিনায়কত্ব থেকে।
যে দলটার নিয়ম হয়ে গিয়েছিলো বড় দলগুলোর বিপক্ষে প্রতিদিন নাস্তানাবুদ হওয়া এমন এক দলকেই দিয়েছেন লড়াইয়ের পুঁজি তৈরি করে। দলের খারাপ সময়টাতে দলের ত্রাতার ভূমিকায় ছিলেন নড়াইলের সেই সাদামাটা কৌশিক।
সেই ২০১০ সালে প্রথমবারের মত অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ম্যাশ। কিন্তু হাঁটুর ইনজুরিতে পড়লে পারেননি সেই দায়িত্বে মনোনিবেশ করতে। এর বছর চারেক পরে আবার ২০১৪ সালে বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় মাশরাফির কাঁধে।
মাশরাফি দায়িত্ব নেয়ার পরে মাঠ ও মাঠের বাইরে দুই জায়গায়ই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পেয়েছে ভালো ফলাফল। শুরুটা হয় দেশের মাঠে নিউজিল্যান্ডকে ৪-০ তে হোয়াইটওয়াশ করে। আর এটাই প্রথম কোনো বড় সাফল্য মাশরাফি এন্ড কোম্পানির। ঐ শুরুর পরে আর পেছন থেকে তাকাতে হয়নি টিম টাইগার্সকে।
তাঁর আমলে অর্জন বলতে বিশ্বকাপের নক আউট পর্ব, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ চার, তিনটি এশিয়া কাপের ফাইনাল এবং প্রথম কোন শিরোপা সবই ছিলো। এর চেয়েও বড় কথা তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশ পেয়েছে জয়ের নেশা।
দলের বাকি সদস্যরা বলেন, মাশরাফির উপস্থিতি মানেই ড্রেসিংরুমে প্রাণের সঞ্চার। এক কথায় তিনি ভয়ডরহীন নির্ভীক এক যোদ্ধা। তিনি কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন সামনে তাও পুরো একটি দল নিয়ে। একজন নেতার এর চেয়ে আর কি ভালো গুণ হতে পারে!
ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেশি সময় ইনজুরির সাথে লড়াই করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। একের পর এক ইনজুরি আঘাত হেনেছে তাঁর পায়ে। বহুবার অপারেশন থিয়েটারে যেতে হলেও প্রতিবারই ফিরেছেন আরো শক্তিশালী হয়ে।
মাশরাফির অভিষেক তাঁর হয় ২০০১ সালে, প্রতিপক্ষ ছিলো জিম্বাবুয়ে। সেই ম্যাচে জিম্বাবুয়ে ৫ উইকেটে জিতলেও প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের হাঁটুতে একদম কাপন ধরিয়ে দিয়েছিলো নড়াইলের কৌশিক।
জিম্বাবুইয়ান ওপেনার গ্রান্ট ফ্লাওয়ারকে রানের খাতা খোলার আগেই সাজঘরে পাঠিয়ে নিজের উইকেটের খাতা খুলেছিলেন তিনি। অভিষেক ম্যাচে ছিলো তিন মেডেন সহ দুই উইকেট।
সেই থেকে শুরু, এখনো চলছে। একে একে এখন পর্যন্ত খেলা হয়েছে তাঁর ২১৯ ওয়ানডে ম্যাচ। আর ওয়ানডে ক্রিকেটে ম্যাশের উইকেট সংখ্যা ২৬৯। সেরা বোলিং ফিগার ৬/২৬।
একজন জীবন্ত কিংবদন্তি যাবার বেলায়ও গেলেন কলার উঁচু করে। অধিনায়কের বিদায়ের দিনে দলের সেরা দুই ব্যাটসম্যানের ব্যাট হাসলো এর চেয়ে বড় ট্রিবিউট আর কি’ই বা হতে পারে। অধিনায়ক মাশরাফি যেমন ছিলেন তেমন আছেন এবং ভবিষ্যৎতেও থাকবেন।
অধিনায়ক মাশরাফি না থেকেও থাকবেন সবসময় ড্রেসিংরুমে। অধিনায়ক মাশরাফি থাকবেন লিটনের শৈল্পিক ব্যাটিংয়ে। অধিনায়ক মাশরাফি থাকবেন মুশফিকুর রহীমের ধারাবাহিকতায়। অধিনায়ক মাশরাফি থাকবেন তামিম ইকবালের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে। অধিনায়ক মাশরাফি থাকবেন গ্যালারী ভর্তি হাজার হাজার পাগলাটে ভক্তদের মধ্যে। অধিনায়ক মাশরাফি থাকবেন লাল সবুজের বিজয় নিশানে।