ঐতিহাসিক পাকিস্তান বধের ২১ বছর আজ!

বোরহান উদ্দিন জাবেদ »

হ্যাঁ, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে স্মরণীয় এবং বিখ্যাত জয়টি আসে এই নর্দাম্পটনে, পাকিস্তানের বিপক্ষে। পরম আস্বাদিত অমরত্ব পাওয়া বিশেষ জয়টা আসে ৬২ রানের ব্যবধানে।

তবে সেটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয় নয়। মে ২৪, এডিনবার্গ, সেদিন স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ। টস জিতে পাক অধিনায়ক ওয়াসিম আকরামের ফিল্ডিং বেছে নেওয়াটা তখনো রহস্য। সেই রহস্যের জাল কাটতে দেয়ার সুযোগ না দিয়ে দারুণ ছন্দে ব্যাট করে যাচ্ছেন দুই টাইগার ওপেনার মেহরাব হোসেন অপি এবং শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। আগের চার ম্যাচে ওপেনিংয়ে সর্বোচ্চ জুটি ছিল ১০ রান। সেই জুটি ছাড়িয়ে দু’জনার বন্ধন যখন ছিন্ন হলো, বাংলাদেশের স্কোর ফিফটি ছাড়িয়ে ৬৯ রান। সাকলায়েন মুশতাকের বলে মঈন খানের স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার হয়ে ৪২ বলে ৯ রান করে সাজঘরে ফেরেন মেহরাব হোসেন অপি। দলীয় স্কোরে আর মাত্র এক রান যোগ করে ব্যক্তিগত ৩৯ রানে বিদায় নেন শাহরিয়ার হোসেন। শিকারী সেই সাকলায়েন মুশতাক।

নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ, বাংলাদেশের হারানোর ছিল খুব কম কিছুই। অন্যদিকে পাকিস্তান গ্রুপ পর্বের টানা চার ম্যাচ জিতে সুপার সিক্স নিশ্চিতের পথে। খেলায় ফিরে আসা যাক। তৃতীয় উইকেটে অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সঙ্গে সহ-অধিনায়ক আকরাম খানের কাঁটায় কাঁটায় ৫০ রানের জুটিতে বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় ১২০/৩। বুলবুল ফিরে যান ১৫ রান করে। দলীয় ১৪৮ রানে ইনিংস সর্বোচ্চ ৪২ রান করে ফিরে যান আকরাম খানও। বাকীদের আসা যাওয়ার মিছিলে খালেদ মাহমুদ সুজন খেলেন ৩৪ বলে ২৭ রানের একটি ক্যামিং ইনিংস। তাতে নির্ধারিত ৩০০ বলের ইনিংসে ১১ বল বাকী থাকতে বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় ২২৩ রানে। সাকলায়েন মুশতাক ৩৫ রান খরচায় শিকার করেন পাঁচ উইকেট। ২২৪ রানের টার্গেট পাকিস্তানের জন্য এক অর্থে মামুলি বলা যায়। তবে টুর্নামেন্টে নিজেদের সর্বোচ্চ রানের স্কোর পেয়েই কিনা তেতে উঠে টাইগাররা।

মাঠজুড়ে দুর্দান্ত ফিল্ডিং এবং শুরু থেকে আঁটসাঁট বোলিংয়ে সেটা ফুটে উঠে দারুণভাবে। আর তাতে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয় পাকিস্তানি টপ-অর্ডার এবং মিডল- অর্ডার। দলীয় স্কোর ফিফটি ছাড়ানোর আগেই ৪২ রানে পাঁচ ব্যাটসম্যান ড্রেসিংরুমে ফিরে গেছেন। শহীদ আফ্রিদিকে মেহরাব হোসেনের ক্যাচে পরিণত করে এবং ইনজামাম উল হক, সেলিম মালিককে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে পাঁচ উইকেটের তিনটিতেই নাম খালেদ মাহমুদ সুজন।

ক্রিকেটে একটা প্রচলিত রেওয়াজ – যেকোনো মুহূর্তে একটা জুটি দাঁড়াবেই। সেটা সত্যি করতে আর দলের ভগ্নদশার হাল ধরতে কিনা সেই মুহূর্তে ষষ্ঠ উইকেটে আজহার মাহমুদের সাথে জমে গেল ওয়াসিম আকরামের জুটি। দুজনের জুটিতে ৫৫ রান, দলীয় শতক থেকে পাকিস্তান দাঁড়িয়ে তিন রান দূরত্বে। সেই মুহূর্তে ওয়াসিম আকরামের শিশুতোষ এক ভুলে রান আউটের শিকার হন আজহার মাহমুদ।

বাংলাদেশের জয়ের প্রদীপে সত্যিকারের আলোটা যেন তখন -ই জ্বলে উঠলো। গ্যালারীর গর্জন, ড্রামস এবং হুইসেলের দুরন্ত বেগে বেজে যাওয়া জানান দিচ্ছিল, বাংলাদেশ সমর্থকদের হৃদয়ে পুনরায় ফিরে এসেছে আশার ঝিলিক। অষ্টম উইকেটে মঈন খানের সঙ্গে সাকলায়েন মুশতাকের ২২ রানের জুটিতে পাক শিবিরে কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চারণ হচ্ছিলো। মঈন খানকে মেহরাব হোসেন অপির ক্যাচ বানিয়ে, সেই থামিয়ে দেন নাঈমুর রহমান। চমক জাগানিয়া বিশ্বকাপের স্মরণীয় জয়টার শেষ মঞ্চায়ন হতে চলেছে! ৪৫-তম ওভারে, দুর্জয়ের দ্বিতীয় বলটা শোয়েব আখতার ঠেলে দিলেন কাভারের দিকে। উদ্দেশ্য এক রান! কিন্তু কাভার থেকে ফিল্ডারের সরাসরি থ্রো আঘাত হানে স্ট্যাম্পে। সাদাচোখে গন্তব্য থেকে সাকলায়েন মুশতাকের ব্যাট ইঞ্চিখানেক দূরত্বে মনে হচ্ছে! মাঠ থেকে আম্পায়ারের নিদের্শনায় থার্ড আম্পায়ারের সংকেতের অপেক্ষা না করে আনন্দ উচ্ছ্বাসে মাঠে নেমে আসে টাইগার ভক্তরা। পিচে তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে সাকলায়েন! পরক্ষণেই লাল বাতির সংকেত জানান দিচ্ছে লাল সবুজের বিজয়ের কেতন উড়তে আর নেই মানা। মাঠের উল্লাস বাড়তে থাকে জলোচ্ছ্বাসের বেগে। সেটা ছড়িয়ে পড়ে ড্রেসিংরুমে।

জয়টা হাজার মাইল দূরে হলেও, এই বঙ্গে জয়োল্লাসে কোন দূরত্ব ছিল না। এতসব কিছুর জন্যেই তো সেই দৌড়টা থেকে গিয়েছিল অসম্পূর্ণ! ম্যাচ পরবর্তী প্রেজেন্টেশনে অধিনায়ক বুলবুলের আবেগাপ্লুত হয়ে পড়াটা মাঠে থাকা হাজারো দর্শককে কাঁদিয়েছিল সেদিন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আরো ম্যাচ জিতেছে, যতদিন ক্রিকেট থাকবে আরো জিতবে। কিন্তু এ জয়টার মাহাত্ম্য একেবারে আলাদা হয়ে থাকবে। সব জয়ের স্মারক হয়ে থাকবে এ জয়টি। এ জয় দিয়েই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার সম্ভাবনা জোরালো করেছিল বাংলাদেশ। তাইতো এই জয়ের রঙ এখনো এতটা রঙিন!

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »