ইতিহাস-ঐতিহ্যের বক্সিং ডে টেস্ট

দুর্জয় দাশ গুপ্ত »

প্রতিবছর আজকের এই দিনে অনুষ্ঠিত  হয় বক্সিং ডে টেস্ট। মাঠের খেলাটা ক্রিকেট কিন্তু এর সাথে ‘বক্সিং’ শব্দটা শুনে অনেকেই মূল ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেন না। অন্যদিকে, বক্সিং শব্দ শুনলেই তো মোহাম্মদ আলীর কথা মনে পড়ে যায়। কারণ তিনিই যে বক্সিং শব্দটাকে একটা শিল্পে পরিণত করেছেন। এই শব্দটাকে বানিয়ে ফেলেছেন নিজের সমার্থক শব্দ।

এ বছর স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার টেস্ট ম্যাচ দিয়ে মাঠে গড়িয়েছে বক্সিং ডে টেস্ট। ঐতিহাসিক মেলবোর্নে আজ শুরু হয়েছে বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচটি।

এমন না যে ক্রিকেট ছেড়ে প্লেয়াররা ঘুষোঘুষিতে জড়িয়ে পড়বেন বলে এর নাম ‘বক্সিং ডে টেস্ট’। এই নামের পেছনে রয়েছে ইতিহাস, রয়েছে সমৃদ্ধি।

বক্সিং ডেঃ

বক্সিং ডে বলতে মূলত বুঝানো হয় বড়দিনের পরের দিনটিকে অর্থ্যাৎ আজকের এই ২৬ ডিসেম্বরকে। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব ক্রিস্টমাস বা যেটাকে বড় দিনও বলা হয়। এদিন ছোট-বড় গরিব-দুখীদের মাঝে অনেক উপহার বিতরণ করা হয়ে থাকে। সামর্থ্যবানরা সব সময়ই বক্সে করে গরিব মানুষদের উপহার দেন।

তবে কেবল ২৫ ডিসেম্বরেই উপহার দেওয়া হয় এমনটা না, উপহার দেওয়া হয় ২৬ ডিসেম্বরও। আর এদিন কমনওয়েলথভূক্ত দেশসমূহে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। প্রাচীন সনাতনী রীতি-নীতি অনুযায়ী গরীব লোকদেরকে উপহার প্রদান করাই আজকের এই দিনের প্রধান ও মূল উপজীব্য বিষয়। এ উপহারসামগ্রী মূলত ‘ক্রিস্টমাস বক্স’ বা ‘বড়দিনের বাক্স’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। আর সেখান থেকেই ২৬ ডিসেম্বরকে বলা হয় ‘বক্সিং ডে’।

বক্সিং ডে টেস্টের ইতিহাসঃ

বড়দিনের ঠিক পরদিন টেস্ট ম্যাচটি শুরু হয় বলে এর আদুরেই নাম হয়ে গেছে বক্সিং ডে টেস্ট। বক্সিং ডে ক্রিকেটে প্রথম শুরু হয়ছিলো সেই ১৮৯২ সালে। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটের দুটি ক্লাব ভিক্টোরিয়া এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় বক্সিং ডে টেস্ট। তবে এর অনেক বছর পর ১৯৫০ সাল থেকে শেফিল্ড শিল্ডের পরিবর্তে এই দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের ঐতিহ্যবাহী টেস্ট ম্যাচ। আর ১৯৫০ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম বক্সিং ডে টেস্ট। এই টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এমসিজিতে খেলেছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড। এরপর থেকেই বিভিন্ন দেশে এই বক্সিং ডে টেস্টের রীতি শুরু হয়।

বক্সিং ডে টেস্টে দর্শকদের চাহিদাঃ

অস্ট্রেলিয়াতে এমনিতেই ক্রিকেট অনেক এগিয়ে। আর এখানে বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচের কদর একদম আকাশচুম্বি। গড়ে প্রতিটি বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনে কমপক্ষে ষাট হাজার দর্শকের উপস্থিতি হয় অস্ট্রেলিয়ায়। তবে প্রতিপক্ষ ভেদাভেদে দর্শকের পরিমাণ অনেক সময় উঠা-নামা করে থাকে। সেই ১৯৯০ সালে বক্সিং ডে টেস্টে এমসিজিতে দর্শক হয়েছিলে ৪৯ হাজার ৭৬৩ জন। এরপর ২০১৪ সালে ভারতের বিপক্ষে স্টেডিয়ামের দর্শকের উপস্থিতি ছিল মোট ৬৯ হাজার ৯৯৩ জন। রেকর্ড প্রায় ৯২ হাজার দর্শক এমসিজিতে উপস্থিত হয়েছিল ২০১৩ সালের বক্সিং ডে’টেস্টে। সেবার অ্যাশেজ ব্যাটেল হওয়ায় এক বাড়তি উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। শুধু প্রথম দিনই না, পুরো বক্সিং ডে টেস্টে মোট দর্শক ছিল ২ লাখ ৭১ হাজার ৮৬৫ জন। দর্শক জনপ্রিয়তায় ওই ম্যাচটি সব দিক থেকে এগিয়ে কিন্তু ১৯৮২ সালে ২ লাখ ১৪ হাজার ৮৮২ জন, ১৯৭৪ সালে ২ লাখ ৫০ হাজার ৭৫০ জন, ১৯৭৫ সালে ২ লাখ ২২ হাজার ৭৫৫ জন দর্শক বক্সিং ডে টেস্টে উপস্থিতছিল। তবে পরিসংখ্যানের বিচারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচেই সবচেয়ে বেশি দর্শক সমাগত ঘটেছিল এখানে।

বক্সিং ডে টেস্টে ইংল্যান্ডের শেষ মুহুর্তের জয়ঃ

১৯৮২ সালের বক্সিং ডে টেস্টে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এক ম্যাচ ক্রিকেট বিশ্বকে উপহার দিয়েছিলো। ম্যাচের শেষ দিন হাতে মাত্র এক উইকেট হাতে রেখে ৩৭ রানের জয়ের জন্যে মাঠে নামে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। চতুর্থ দিন থেকেই ব্যাটিং করে আসছিলেন জেফ থমসন ও অ্যালান বোর্ডার জুটি। শেষ দিনেও তাদের ব্যাট ধরে জয়ের স্বপ্ন দেখতে থাকে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু ম্যাচের ঠিক শেষ মুহুর্তেও রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছিল এই ম্যাচের। ৩৭ রানের প্রয়োজনে ব্যাটিং করতে নেমে একদম জয়ের বন্দরে এসে তিন রানে হেরে যায় স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। শেষ জুটিতে থমসন ও বর্ডার যোগ করেছিলেন ৭০ রান। কিন্তু তবুও পারেন নি দলকে জয় উপহার দিতে৷

বক্সিং ডে টেস্টে হ্যাট্রিকঃ

১৯৯৪ সালে সফরকারী ইংল্যান্ডকে সহজেই বক্সিং ডে টেস্টে হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার শেন ওয়ার্ন ঐতিহাসিক এমসিজিতে হ্যাটট্রিক করেন। হ্যাটট্রিকের শেষ উইকেটটি ছিল একদম চমকপ্রদ। ডেভিড ম্যালকমকে আউট করার জন্যে শর্ট লেগে দাঁড়ানো ফিল্ডার, এই টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান ডেভিড বুন এক হাতে ড্রাইভ দিয়ে অসাধারণ একটি ক্যাচ নেন।

বক্সিং ডে টেস্টে মুরালির ঐতিহাসিক নো বলঃ

১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া বক্সিং ডে টেস্ট বিরল এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকবে সারাজীবন৷ প্রতিবার বক্সিং ডে টেস্ট আসলেই এই ঘটনা আলোচনায় চলে আসে। প্রায় ৫৬ হাজার দর্শকের সামনে আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার মাত্র তিন ওভারে শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনের সাতটি বল চাকিংয়ের অভিযোগে ‘নো’ বল ঘোষণা করেন। অবাক হয়ে আম্পায়ারের দিকে তাকানো থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না মুরালির। মাথা পেতে নিতে হয়েছে আম্পায়ারের এমন সিদ্ধান্ত৷

সন্ধ্যার পরে টেস্টের ফলাফলঃ

১৯৯৮ সালের বক্সিং ডে টেস্টে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের ম্যাচ শেষ হয় সন্ধ্যা ৭ টা ৩৩ মিনিটে। টেস্টের প্রথম দিন কোনো খেলাই মাঠে গড়ায় নি। শেষের চারটা দিন দাপটের সঙ্গে লড়াই করলেও শেষ দিকে অজিরা মাত্র ১২ রানে হেরে যায়। ইংলিশ বোলার ডিন হেডলি মাত্র ২০ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট শিকার করে অস্ট্রেলিয়াকে একদম মাটিতে নামিয়ে আনেন। ম্যাচ শেষ হয় বিকেল গড়িয়ে গিয়ে একদম সন্ধ্যায়।

শেন ওয়ার্নের ৭০০ উইকেটঃ

২০০৬ সালের বক্সিং ডে টেস্ট খেলেই ক্রিকেটকে বিদায় জানান কিংবদন্তি শেন ওয়ার্ন। বড়দিনের পরের দিন অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর ওয়ার্ন তার ক্যারিয়ারের ৭০০তম উইকেট লাভ করেন। ইংল্যান্ডের ওপেনার অ্যান্ড্রু স্ট্রকসের উইকেট নেওয়ার পরপরই উপস্থিত ৮৯ হাজার ১৫৫ দর্শক শেন ওয়ার্নকে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান। সর্বকালের সেরা এই লেগ স্পিনার নিজের নামের পাশে মোট ৭০৮ টি টেস্ট উইকেট নিয়ে ক্রিকেটকে বিদায় বলেন।

বক্সিং ডে টেস্টে কিউইরাঃ

৩২ বছর পর আজ আবারো বক্সিং ডে টেস্ট খেলতে নেমেছে নিউজিল্যান্ড। ৩২ বছর আগে এই মেলবোর্নেই স্বাগতিকদের কাছ থেকে জিততে জিততেও শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিত ভাবে টেস্ট ম্যাচটি শেষ করতে হয়েছে কিউইদের। এরপর

বক্সিং ডে টেস্টে স্মিথের রেকর্ডঃ

২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর বক্সিং ডে টেস্টে সেঞ্চুরি আছে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান স্টিভেন স্মিথের। বক্সিং ডে টেস্টে স্মিথের মত এক টানা চার বছর সেঞ্চুরি করার রেকর্ড আর কারো নেই। নিষেধাজ্ঞার কারণে গতবছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের বক্সিং ডে টেস্ট খেলা হয়নি স্মিথের। তবে এবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বক্সিং ডে টেস্টে আবারো ফিরেছেন তিনি। প্রথম দিনটাও শেষ করেছেন দাপট দেখিয়ে। আরো একটা সেঞ্চুরি হয়তো আসছে আগামীকালই।

এ বছরের বক্সিং ডে ম্যাচগুলোঃ

আজ ২৬ শে ডিসেম্বর বক্সিং ডে টেস্টে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) মুখোমুখি হয়েছে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ও সফরকারী নিউজিল্যান্ড। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার ডরবানে বক্সিং ডে টেস্টে খেলছে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা ও সফরকারী ইংল্যান্ড।

হিস্টোরি, কালচার, কম্পিটিশন, ক্লাইম্যাক্স-এন্টি ক্লাইম্যাক্স কি নেই? সবকিছু মিলিয়ে প্রতিবছরে একবার বক্সিং ডে হাজির হয় টেস্ট ক্রিকেট সমর্থকদের জন্য যাদুর বাক্স নিয়ে! এ যেন আলাদিনের যাদুর চেরাগ!

এখানেই ওয়ার্নিরা ৭০০ তম উইকেট পায়, এখানেই স্বাগতিক অজিরা রাইভাল ইংলিশদের বিপক্ষে মাত্র ৯৮ রানে অলআউট হয়, ২০১৩/১৪ অ্যাশেজের বক্সিং ডে তে এই এমসিজিতেই দর্শক উপস্থিতি ছিলো রেকর্ড সংখ্যক প্রায় ৯২,০০০!

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »