সাজিদা জেসমিন »
রবিনের ছোটবেলা কেটেছে ক্রিকেট ক্রিকেট করেই। ক্রিকেট বলতেই উন্মাদ ছেলেটা। কিন্তু বাবার সামর্থ্যের কাছে ক্রিকেটার হওয়ার মতো স্বপ্ন ঠিকিয়ে রাখা মুশকিল ছিলো। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম বলেই হয়তো এতোটা প্রতিভা থেকেও ছেলেটা আজ অবহেলিত। বোলারের চোখ দেখে সে আন্দাজ করতে পারতো তার মনে কি চলছে। আর এরপর বোলারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তো।
পাড়ার সবাই বলতো এই ছেলেটা সুযোগ পেলে অনেক দূর যাবে। হয়তো জন্ম দিবে কোনো কালজয়ী ইতিহাসের। চালিয়ে যা সফল হবি একদিন। সবার বাহবাগুলো যেনো অনেক বেশি সাহস যোগাতো রবিনের কোমল মনে। সেই সাহসের জোরেই স্বপ্ন দেখতো সে একদিন অনেক বড় ক্রিকেটার হবে। দেশের নাম-জশ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। বাবা-মা বলতেন শোন বাবা,তোকে বড় করছি এই দেশের জন্য। এই দেশের মান রাখিস বাবা। মনে রাখবি সবার আগে দেশ।
রবিন বাধ্য বালকের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতো হ্যা বাবা মনে থাকবে আমার। ধীরে ধীরে পাড়ার সেই ডাঙ্গর ছেলেটা বড় হয়ে উঠলো। সাথে সাথে সবদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। সবাই এক নামে চেনে ‘ক্রিকেটার রবিন’। বাবা-মা প্রাণভরে ছেলেকে দোয়া করেন। ছেলে একদিন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলবে। হয়তো স্বপ্নটা সত্যি হতেই চলছিলো। রবিন বিভাগীয় পর্যায়ে সুযোগ পেলো। স্বপ্নের দিকে এগিয়ে গেলো একধাপ। রবিনকে হয়তো আর পিছন ফিরে তাকাতে হবেনা। বরাবরই তার পারফরমেন্স অনেক ভালো। সামনে বিশাল ম্যাচ আছে। যদি ভালো করতে পারে তবে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিতে রুবিনের আর বেশিদিন অপেক্ষা করা লাগবেনা।
রবিন বাড়ি এসে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে গেলো। বাবা বললেন বাপরে ঐ লাল-সবুজ জামাটা গায়ে দিয়ে আমায় একটু দেখাস। মরেও শান্তি পাবোরে। দেশের জন্য তোরে কোরবানী করে দিলাম বাপ। আর কিছুই তো করতে পারলাম নাহ। বাবাকে আশ্বাস দিলো রবিন যে সে বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু ভাগ্যের আরেক নির্মম পরিহাস অপেক্ষা করছিলো রবিনের জন্য। রবিনের বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লো। অনেক টাকার দরকার। কি করবে সে এখন? কই পাবে এতো টাকা?
বাবা ছেলেকে বোঝালেন আগে ম্যাচে মনোযোগ দে। আমি তোর জয় দেখতে চাই। স্টেডিয়ামে বসে আমি তোর খেলা দেখতে চাই। কি বাবা দেখাবিনা আমাকে? তোর খেলা দেখে শান্তিতে মরতেও রাজি আছিরে। চোখের জল মুছে রবিন বললো দেখাবো বাবা। অপেক্ষা করো আমি নিতে আসবো। রবিন শহরে ফিরে গেলো। সামনে ম্যাচ। তুমুল প্রাকটিস চলছে। জিততেই হবে এই ম্যাচে। সবচেয়ে বড় কথা রবিন স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি এই ম্যাচ। হয়তো এই ম্যাচের পরই বদলে যাবে রবিনের জীবন।
কিন্তু আসলেই কি ঘটতে চলেছিলো ম্যাচে???
মাচের ২দিন আগে —-
একটা ফোন কল এলো রবিনের কাছে। ফোন রিসিভ করতেই। পার্কে দেখা করো আজ বিকেলে। জরুরী কথা আছে।
কে আপনি???
সেটা তোমার জানার প্রয়োজন নেই। তোমার জীবন পাল্টে যাবে। এই সুযোগ হারাতে বসোনা। এরপর ফোন অফ।।।
রবিন কিছু বুঝে উঠার আগেই ফোন কেটে গেলো। সে ভাবতে বসলো কে হতে পারে??? যেই হোক পার্কে গেলেই দেখা যাবে। রবিন পার্কে গিয়ে পায়চারী করতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো কে হতে পারে লোকটা? পরিচিত বলেতো মনে হলোনা। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ কাঁধের উপর হাত রাখতেই চমকে উঠলো রবিন।
পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো দুজন কদাকার লোক। মুখে অদ্ভুতরকম এক হাসি। দেখতে কেমন জানি আজীব লাগছে।
রবিন : কে আপনারা? আর আমাকে কেনো ডেকেছেন???
আগন্তুক : শোনো ছেলে। তোমার লাভের জন্যই তোমাকে ডেকেছি। পুরোটা শোনো,তারপর বলো। সামনের ম্যাচে তুমি কোনো রান নিবেনা।
রবিন : মানে?
আগন্তুক : মানে খুবই সোজা। তুমি রান না নিয়ে আউট হয়ে যাবে। আর আমরা চাই তোমার টিম ম্যাচটা হারুক।
রবিন : কিন্তু আমি এটা কেনো করবো? পারবোনা কিছুতেই।
আগন্তুক : মোটা অংকের টাকা পাবে কিন্তু। বাবার চিকিৎসা করাবেনা? এভাবে উনাকে মরতে দিবে??
রবিন : বাবা??? আপনি কি করে জানলেন আমার টাকার প্রয়োজন??কে আপনারা???
আগন্তুক : আমরা সব জানি। আমরা কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে। আগে যা বলছি করো।
রবিন : আমি পারবোনা। আপনারা চলে যান।
আগন্তুক : ঠিক আছে যাচ্ছি। তবে আবার ফোন দিবো। যদি রাজি থাকো তোহ বলো। আমরা অপেক্ষায় থাকবো। রবিন চলে গেলো।
কিন্তু সে সারাক্ষণ ভেবেই যাচ্ছিলো। একটা ম্যাচ ই তো হারতে হবে। এটা আর এমন কি? ম্যাচ জিতলে বাবার স্বপ্ন পূরণ হবে। আর হারলে বাবার চিকিৎসার টাকা ম্যানেজ হবে। বাবাই যদি বেঁচে না থাকে,তবে স্বপ্ন পূরণ করে আর কি লাভ?
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। রবিন তুলতেই ওপাশ থেকে– কি হলো কি ভাবলে??? রাজিতো??
রবিন : আর ভাবার সময় নেই। বাবাকে বাঁচাতে হবে। হ্যা রাজি। আমাকে কি করতে হবে?
আগন্তুক : চমৎকার। তবে শোনো – তোমাকে কোনো রান ছাড়াই আউট হতে হবে। আর তুমি আউট হলে বাকিরা এমনিতেই নার্ভাস হয়ে পড়বে। এটুকু করলেই চলবে।
ঠিক আছে। রবিন ফোন রেখে দিলো।
রবিন ভাবতে লাগলো যে কাজটা কি ঠিক হলো?? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো। পরদিন গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসলো প্রতিশ্রুতিমতো। কিন্তু তখনো রবিনের মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো সে কি আসলেই ভুল কাজ করতে চলেছে?
রবিনকে চিন্তিত দেখে বাবা জানতে চাইলেন কি হলোরে রবিন? কি ভাবছিস এতো?
বাবা জানলে কষ্ট পাবে তাই রবিন এড়িয়ে গেলো ব্যাপারটা। বললো – কিছু না বাবা। কাল কি হবে ভাবছি।।
বাবা বললেন – আরে দূর পাগল। আমি জানি তুই ভালো খেলবি। তোর উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। বাবার কথা শুনে রবিন হতবাক হয়ে রইলো। কোনো শব্দ বের হচ্ছিলো না মুখ দিয়ে।
একটু পর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো – আচ্ছা বাবা তোমার কেনো মনে হয় যে ক্রিকেট দিয়ে আমি দেশের জন্য বিরাট কিছু করতে পারবো? আর ক্রিকেটের প্রতি এতো আবেগের মূল কারণটা কি??
শুনতে চাস??? তবে শোন। এই দেশীয় ক্রিকেট আবেগের জন্যই প্রাণ দিয়েছেন আমাদের এ মাটির বীর সন্তান শহীদ জুয়েল-মুসতাক-রকিবুল। যাদের রক্ত আমি ঐ ক্রিকেট বল আর ব্যাটে যেন দৃশ্যমান দেখি সবসময়। যাদেরকে আমি ঐসব ক্রিকেটার,ক্রিড়াব্যক্তিত্বের মধ্যে দেখি যারা দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনেন। এ দেশের হয়ে প্রাণপণ লড়াই করেন ক্রিকেট মাঠে।
জুয়েল ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি উইকেট কিপিংটাও করত চমৎকার, ব্যাট হাতে মাঠে নামার পর বোলারদের নাস্তানাবুদ করতো। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ওপেনিংয়ে নামতো। স্লগ সুইপটা অসাধারন খেলত।কিন্তু তখন সময়টাই খারাপ ছিলো। ছেলেটা স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে ওপেনিং করার কথা ভাবতো। শহীদ জুয়েল নামেই পরিচিত ছেলেটা।
সে সময় পূর্ব পাকিস্তান দলে যে কয়েক বাঙালি স্থান পান, তিনি তাঁদের একজন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সফরে আসে নিউজিল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দল। এ সফরে খেলার জন্য জুয়েল পাকিস্তান ক্যাম্পে ডাক পেলেও মূল দলে সুযোগ পাননি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের শেষ দিকে ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে যান শহীদ জুয়েল। সেখানে মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্ল্যাটুনে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেন।
এরপর শহীদ মুস্তাক।। ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম ক্লাব আজাদ বয়েজ ক্লাব। এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মুশতাক নিজ হাতে ক্লাবটি গড়ে তুলেছিলেন। ২৫ শে মার্চের কালরাতের পর থেকে ক্রিকেট পাগল মুশতাক নিখোঁজ। অনেক খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছিলোনা। ২৭ শে মার্চ আশরাফুল ভাইকে নিয়ে ঢাকা জেলা ক্রীড়া পরিষদ ভবনের সামনে প্রিয় বন্ধুর ঝাঁজরা দেহ দেখে স্তব্ধ হয়ে পড়েন জুয়েল। হাতদুটো উপরে ধরা। খেলা ছাড়া যে লোকটা কিছু বুঝত না। প্রিয়বন্ধুর দিকে তাকিয়ে শপথ হায়েনাগুলোকে গোঁড়া থেকে উৎখাত করার শপথ নেন জুয়েল।
মৃত্যুর পর জানাজা ও পাননি তিনি। ফজরের নামাজ পড়ে আজাদ বয়েজ ক্লাবের দিকে যাওয়ার সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে তাড়া করে আজাদ বয়েজ ক্লাবের পাশে ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার চত্বরের মধ্যে গুলি করে হত্যা করে। ওর মৃতদেহ পরবর্তী কয়েকদিন ওখানে পড়েছিল।
১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ জেলা ক্রীড়া ভবনের সামনে সদাহাস্যজ্বল মুশতাক ভাইয়ের দু হাত উপরে তোলা ডেড বডিটা পড়ে থাকতে দেখার পর ছেলেটার স্বপ্নটা একটা ধাক্কা খেল, নিষ্প্রাণ ঝাঁজরা দেহটা পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। হাতদুটো উপরে ধরা। বিনা অপরাধে এইভাবে মরতে হবে, মৃত্যুর আগমুহূর্তেও হয়তো এটা তার কল্পনাতেও ছিল না। মুশতাক ভাইয়ের সেই দৃষ্টি জুয়েল ছেলেটার মাথায় গেঁথে গেল, ব্যাট ফেলে তুলে নিল স্টেনগান, পাকি শুয়োরগুলারে মারতে হবে, দেশটারে স্বাধীন করতে হবে…
প্রথমে বাঁধা হয়ে এসেছিল স্নেহময়ী মা। ছোটবেলা থেকে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা মায়ের চোখকে ফাকি দিয়ে মে’র ৩১ তারিখ বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় ছেলেটা।
যাবার কদিন আগে মাকে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিল, “আমি যখন থাকবো না, এই ছবিটাতে তুমি আমাকে দেখতে পাবে।”
দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে গেরিলা ওয়ারফেয়ারের কিংবদন্তী মেজর এটিএম হায়দার ১৭ জন তরুনকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে ঢাকায় অপারেশনে পাঠান। এরাই পরবর্তীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অকল্পনীয় ত্রাস “ক্র্যাক প্লাটুন” এ পরিনত হয়। সেই ছেলেটা এই ১৭ জনেরই একজন ছিল। সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনের রেকি করতে গিয়ে রামপুরা বিলে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে ডান হাতের তিনটা আঙ্গুল ভেঙ্গে গর্ত হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার। হাতটাকে পচনের হাত থেকে বাঁচাতে আঙ্গুলগুলা কেটে ফেলতে হবে, হঠাৎ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে আর্তি জানায় ছেলেটা, “দেশ স্বাধীন হইলে আমি ন্যাশনাল টিমের হইয়া ওপেনিংয়ে নামুম, ক্যাপ্টেন হমু। আঙ্গুল তিনটা রাইখেন স্যার, প্লিজ…”
ডাক্তার ছেলেটার স্বপ্নটা ভেঙ্গে দেন নাই, আঙ্গুল তিনটা রেখেছিলেন। খুব অস্থির হয়ে যেত ছেলেটা মাঝে মাঝে। আঙ্গুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ চেহারায় কি যেন ভাবতো। সহযোদ্ধা আলমের ছোটবোন পুলু যখন ছেলেটার ভাঙ্গা আঙ্গুল তিনটা ড্রেসিং করতো, তখন প্রচণ্ড যন্ত্রণা লুকিয়ে হাসতে হাসতে আপাকে ছেলেটা বলতো, ”আরে আপা, বুঝলা না, স্বাধীন বাংলাদেশের হয়া ওপেনিং করুম দেইখাই তো পাকিস্তান ভাইঙ্গা দিতাছি। খালি স্বাধীন বাংলাদেশটা হইতে দে, দেখবি ক্যামনে পাইক্কাগুলারে হারাই। ওপেন করতে নাইমা পিটাইতে থাকুম, পিটাইতে পিটাইতে ছাল বাকলা তুইলা ফেলুম। শালার আঙ্গুল তিনটায় গুলি না লাগলেই আর সমস্যা হইত না। কবে যে ভালো হইব কচু, কবে যে ব্যাট ধরতে পারুম…”
২৯ শে আগস্ট ছেলেটা মগবাজারে আজাদের বাসা থেকে ধরা পড়ে। ধরা পড়ার সময়ও ছেলেটার বুকের গহীনে সেই আকাশছোঁয়া স্বপ্নটা ছিল, দেশের হয়ে ওপেনিংয়ে ব্যাট করার স্বপ্ন, স্বপ্নটার মধ্যেই বাস করতো ছেলেটা। ধরে নিয়ে যাবার সময় আজাদদের বাসায় ছেলেটার ভাঙ্গা আঙ্গুল তিনটা ধরে যখন মোচড় দিচ্ছিল পাকি ক্যাপ্টেন, তখনো স্বপ্নটা ছেলেটাকে ঘিরে ছিল। টর্চার সেলে আঙ্গুলগুলোর উপর হাতুড়ির বাড়ি পড়তো প্রতিদিন নিয়ম করে, প্ল্যায়ার্স দিয়ে মুচড়ে ধরে জিজ্ঞেস করতো শুয়োরগুলো, “মুক্তি কা রুট কিধার হ্যায়, হাতিয়ার কাহা সে আ রাহা”, তখনো স্বপ্নটা ছেলেটাকে ছেড়ে যায়নি। স্বপ্নটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলো ছেলেটা…
জীবনের শেষ ইনিংসে ছেলেটা অপরাজিত ছিল, অপরাজিত ছিল তিনটা আঙ্গুল ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও। তারপরও ছেলেটা স্বপ্ন দেখা ছাড়েনি।
এরপর শহীদ রকিবুল…..
বাবাকে থামিয়ে দিলো রবিন। বাবা আর সহ্য করতে পারছিনা বাবা। আর পারছিনা। আমি লড়বো বাবা। আমি প্রাণপণ লড়বো। আমাকে জিততেই হবে। বাবা জড়িয়ে ধরলেন রবিনকে। নাহ। রবিন আর কিছু ভাবতে পারছেনা। মাথায় শুধু জুয়েলের কথা গুলো ভাসছে। আর কিছু ভাবতে পারছেনা সে। প্রলোভন দেখানো ঐই দুই শয়তানকে তখন রবিনের পাক হায়েনাদের মতো মনে হচ্ছিলো। মনে মনে ভেবে নিলো কাল আমার যুদ্ধটা জুয়েল আর পাক হায়েনাদের বিরুদ্ধে। কারণ যারা দেশের খেয়ে দেশের বিরোধ করে তারা ঐ পাক হায়েনার মতোই নিকৃষ্ট। আর রবিন কখনো শহীদ জুয়েলের আদর্শকে অস্বীকার করতে পারেনা।
কতবড় ভুল করতে যাচ্ছিলো সে। লোভে পড়ে এতবড় একটা ভুল??? বাবা জানতে পারলে ঘৃণায় মারা যেতেন। বাঁচিয়েছো বাবা তুমি আমার বিরাট অপরাধের হাত থেকে। মনে মনে বলছিলো রবিন। কাল যে করেই হোক জিততেই হবে। বাবার স্বপ্নপূরণ করবোই করবো। এই বলে রবিন ঘুমিয়ে পড়লো। আর স্বপ্নে অদ্ভুত এক কান্ড ঘটলো। সে দেখলো বাবার বয়সী এক লোক রবিনকে ডাকছেন। কাছে যেতেই – শুভ কামনা বাবা। ভালো খেলে জয় ছিনিয়ে আন। তবেই আমাদের আত্মা তৃপ্ত হবে। চিনতে পারলোনা ঠিক। হঠাৎ হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো সেই ক্ষত আঙ্গুল। আর বুঝতে বাকি রইলো না রবিনের। জড়িয়ে ধরলো। আর বললো হ্যা অবশ্যই জিতবো আমরা। আমার জিততেই হবে।
এরপর ঘুম ভেঙে গেলো। দেখলো সকাল হয়ে গেছে। নাস্তা সেড়ে বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রবিন। আজ তার বিরাট পরীক্ষা,তাকে পাশ করতেই হবে। মাঠে পৌঁছেই রবিনের তোপ শুরু, একের পর এক মারতে মারতে দলের জয় অনেকটাই নিশ্চিত করে দিলো রবিন। বাকি কাজটা বোলাররাই করে দিলো। জয় হলো রবিনের টিমের। রবিন দৌড়ে এসে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে বাবার গায়ে জড়িয়ে দিলো। আর বললো বাবা আমরা শহীদ জুয়েল-মুসতাক-রকিবুলের উত্তরসূরি । আমরা এদেশের সন্তান,এ মাটির সন্তান। এ মাটির গন্ধ আমাদের গায়ে মিশে আছে। কখনে এর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে দিবোনা ।
আর জয়ে বিরাট ভূমিকা রাখার ফলস্বরূপ রবিনের ভাগ্যে জুটলো লাল-সবুজ ড্রেসের অংশীদার হওয়ার সুযোগ। সাথে পূরণ হতে চললো বাবার স্বপ্ন। আর ঐ দালালদের মাথায় হাত পড়লো। আর বাবা?? বাবা এরপর আরো অনেকদিন বেঁচে ছিলেন। উনার যে বাঁচতেই হতো। ছেলেকে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে না দেখে কি উনি এতো সহজে ছেড়ে যেতে পারেন??? রবিন দেখিয়ে দিলো দেশেপ্রেমের কাছে দুনিয়ার সবকিছুই মূল্যহীন। সবার আগে দেশ, তারপর বাকিসব। দেশ ই মা, মাতৃভূমি।
উল্ল্যেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে যাদের আত্মত্যাগে অর্জিত এ-ই স্বাধীনতা। বিজয় দিবসে সেই সকল শহীদদের এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। পাশাপাশি ইচ্ছে ছিলো শহীদ জুয়েল-মুস্তাক-রকিবুলকে স্মরণ করা (শহীদ জুয়েল-মুস্তাকের কাহিনী গুগল থেকে সংগৃহীত) । সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।