আইসিসির সদর দপ্তর – মরুভূমিতে এক ফুটন্ত গোলাপ

বিশেষ প্রতিবেদন »

ক্রিকেট বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা । সেইসাথে বাংলাদেশ ক্রিকেটে এগিয়েছে বহুদূর । বাংলাদেশ দলে উথান হয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার । রয়েছেন বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ তামিম, মাশরাফি, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ আর মোস্তাফিজের মতো বিশ্বমানের ক্রিকেটার, যারা এখন আমাদের দেশের গর্ব ।

এই ক্রিকেটকে নিয়ন্ত্রণ তথা পরিচালিত করছে “আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা” যা আইসিসি নামে অধিক পরিচিত । বর্তমান আইসিসি এর সদর দপ্তর মরুভূমির দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে স্পোর্টস সিটিতে অবস্থিত । মূলত একজন ক্রীড়া সংগঠক ও ক্রিকেট প্রেমী হিসেবে অনেক আগে থেকেই আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আইসিসি সদর দপ্তর পরিদর্শনের । তাই সুযোগটা ব্যাটে বলে মিলে যায় গত বছর (২০১৯) ২৬ ডিসেম্বর । আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিতে ৫ দিনের সফরে অবস্থান করি দুবাইতে । মূলত সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় ২৮ ডিসেম্বর এবং ২৯ ডিসেম্বর সকালে মূল শহর থেকে বের হই আইসিসি সদর দপ্তর পরিদর্শনে । অবশ্য বাংলাদেশে থাকা অবস্থাতেই সদর দপ্তর পরিদর্শনের অনুমতি নিয়ে নেই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ।

মূল শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে দুবাই স্পোর্টস সিটি সেন্টার আর দুবাই স্পোর্টস সিটির দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে মাত্র চার মিনিটের দূরে অবস্থিত, আইসিসি সদর দফতরটি ।  বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট সুবিধাসহ রয়েছে আইসিসি ক্রিকেট একাডেমি, দেখতে অনেকটাই বাংলাদেশের বিকেএসপির মতো। তবে এখানে রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া, বিশাল একটি হোটেলও তৈরি হয়েছে সেখানে। অনেকের কাছে যা এখানকার গেম ভিলেজ, যেখানে একসঙ্গে অন্তত ৩০০ জন খেলোয়াড় থাকতে পারবেন। ইতোমধ্যে কাঙ্খিত দপ্তরের সামনে চলে এসেছি আমি । তবে ভিতরে প্রবেশ করতে করতে জেনে নেই দুবাইয়ে অস্থানের পূর্বে বিশ্ব ক্রিকেট সংস্থাটির সদর দপ্তরের পিছনের ইতিহাস………

প্রতিষ্ঠার শুরুতে লর্ডসে আইসিসির কার্যক্রম পরিচালিত হত। ১৯৯৩ সালে লর্ডসের নার্সারি প্রান্তে অবস্থিত “ক্লক টাওয়ার” ভবনে আইসিসির কার্যালয় স্থাপিত হয়। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রধান প্রতিযোগিতা বিশ্বকাপ হতে অর্জিত রাজস্ব স্বাধীনভাবে আইসিসির কার্যক্রম চলতো এবং অধিকাংশ সদস্য দেশসমূহ ইংল্যান্ডের দ্বৈত-কর নীতির সাথে একমত ছিল না, তাই আইসিসির রাজস্ব রক্ষার জন্য একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পরে। তাই ১৯৯৪ সালে যুক্তরাজ্যের বাইরে মোনাকোভিত্তিক আইসিসি ডেভেলপম্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেড বা আইডিআই নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। নব্বই দশকের বাকি সময় আইসিসির প্রশাসনিক কার্যক্রম সঠিকভাবে চলেছিল। কিন্তু ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত আইসিসির বিভিন্ন ইভেন্টের আয়োজনের অধিকারসত্ত্ব, আইসিসির লভ্য রাজস্ব ও সদস্য সংখ্যার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির কারণে মোনাকোতে অবস্থিত আইডিআইয়ে বেশকিছুসংখ্যক বাণিজ্যিককর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। এর ফলে লর্ডসে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ তাদের বাণিজ্যিক সহকর্মীদের থেকে আলাদা হয়ে পরেন। তাই কাউন্সিল তাদের সকল কর্মকর্তাদের এক কার্যালয়ে একীভূত করা এবং একই সাথে বাণিজ্যিক আয় কর থেকে রক্ষার পথ খুঁজতে থাকে।

আইসিসি লর্ডসে তাদের সকল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইংরেজ ক্রীড়া পরিষদের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাছে লন্ডনে পরিচালিত সকল কার্যক্রমের (বাণিজ্যিক কার্যক্রমসহ) জন্য বিশেষ কর মওকুফসংক্রান্ত ছাড়ের জন্য আবেদন করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার আইসিসির জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরই প্রেক্ষিতে আইসিসি বিভিন্ন জায়গায় তাদের কার্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে তাদের কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৫ সালের আগস্টে আইসিসি মোনাকো ও লন্ডনে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দুবাইয়ে তাদের কার্যক্রম সরিয়ে নেয়, যা আইসিসির কার্যনির্বাহী বোর্ডের পক্ষে ১১-১ ভোটে পাস হয়।

দুবাইয়ে আইসিসির কার্যালয়ের বদলের প্রধান কারণ ছিল একটি কর সহনীয় জায়গায় তাদের সকল কর্মীদের একীভূত করা। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশীয় নতুন ক্রিকেট পরাশক্তি কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা। আইসিসি যখন এমসিসি দ্বারা পরিচালিত হত তখন লর্ডস ছিল পরিচালনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা (১৯৯৩ সাল পর্যন্ত)। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেট বিশ্বে নতুন উঠতি শক্তি হিসেবে জানান দিলে কেবলমাত্র ব্রিটিশ সদস্য (এমসিসি) দ্বারা পরিচালনা অযৌক্তিক হয়ে দাঁড়ায়। তাই ১৯৯৩ সালে নতুন পরিবর্তনের পর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লর্ডস থেকে আরো নিরপেক্ষ জায়গায় স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং ২০০৫ সালে দুবাইয়ে সদর দপ্তর স্থানান্তিত হয় আইসিসি ।

অবশেষে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ কপালে উঠে পরলো, পরিপাটি ও সৌন্দর্য্যের পরতে সাজানো নিচতলায় আইসিসির বড় ইভেন্টগুলোর (আইসিসি ট্রফি, বিশ্বকাপ ট্রফি, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) রেপ্লিকা ট্রফি দেয়ালে কাচের মূরালে রাখা । অভ্যর্থনা ডেস্কে আমার পরিচয় দিতেই আমাকে দোতলায় যেতে বললেন । আমাকে স্বাগতম জানালেন আইসিসির উন্নয়ন কর্মকর্তা ইকবাল ভাই । তিনি তার সাথে করে দোতলায় অবস্থিত যাকিছু রয়েছে আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখালেন এবং বিস্তারিত বললেন । দারুণ একটা সময় কাটালাম তার সাথে । ভদ্রলোক একি সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং আমাকে আপ্যায়ন করতে ভুললেন না । সত্যিই খুবি গর্ববোধ হচ্ছিল তখন । তিনতলা বিশিষ্ট সদর দফতরটিতে ২য় তলায় চারটি সভা কক্ষ রয়েছে। কক্ষগুলো যথাক্রমে ক্রিকেটের চার কিংবদন্তি ভারতের শচীন টেন্ডলকার, ইংল্যান্ডের ডব্লিউ. জি. গ্রেস, অষ্ট্রেলিয়ার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্যারি সোবার্স এর নামে নামকরণ করা হয়েছে । এছাড়াও ৩২ টি অফিস রুম, একটি বোর্ড রুম এবং একটি প্রেস কনফারেন্স রুম রয়েছে । পুরো ভবনেই দেয়ালে টাঙ্গানো আছে স্মরণীয় মুহূর্ত্যের ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট বাঁধাই সম্বলিত ছবি ।দেখতে দেখতে প্রায় ২ ঘন্টা অতিবাহিত হলো । ইকবাল ভাইকে ধন্যবাদ জানালাম ও আমাদের ময়ূরপঙ্খীর বিশেষ সুভিনিউরটি উপহার হিসেবে দিলাম, দারুণ খুশি হলেন তিনি । অসাধারণ কিছু ভালো লাগা মুহূর্ত পার করলাম এখানে । একেই বলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা । একদিকে ইচ্ছেপূরণ আর অন্যদিকে পরিদর্শনের ফলে দেখলাম এবং জানলাম । সত্যিই বলতে হচ্ছে, মরুভূমির বুকে এক ফুটন্ত গোলাপ- আইসিসির সদর দপ্তর ।।

লেখক : রুহিত সুমন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ময়ূরপঙ্খী শিশু-কিশোর সমাজকল্যাণ সংস্থা ও ময়ূরপঙ্খী ইয়ুথ এন্ড স্পোর্টস কাউন্সিল

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »