নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডেস্ক »
জাতীয় দলের বাইরে অনেকদিন, অনেক বছর হয়ে গেছে। অনেকের আবার মনেই নেই তার কথা। কিন্তু তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক। অধিনায়ক দিয়ে কথা না, যতদিন দলে ছিলেন, সুযোগ পেয়েছেন, সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। বলছিলাম সাবেক অধিনায়ক রাজিন সালেহের কথা। বদলে যাওয়া বাংলাদেশ দলের একজন অন্যতম যোদ্ধা আজ কেমন আছেন, ক্রিকেট ছেড়ে দেবার কারণ কি এসব নিয়ে আলোচনা করতেই নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কম এর মুখোমুখি রাজিন সালেহ।
নিউজ ক্রিকেট ২৪ : কেমন আছেন রাজিন ভাই? আপনার এখনের ব্যস্ততা কি নিয়ে?
রাজিন সালেহ : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। ক্রিকেট কোচিং নিয়েই ব্যস্ততা। আমার বাসার কাছে একটা একাডেমী আছে। একাডেমী নিয়েই ব্যস্ত থাকি। সিলেট ডিভিশনের কিছু সিনিয়র প্লেয়ার আছেন যাদের সাথে ব্যাটিং নিয়ে কাজ করি। এছাড়া সিলেটের প্রাইভেট একটা ইউনিভার্সিটিতে স্পোর্টস নিয়ে কাজ করি।
নিউজ ক্রিকেট ২৪ : বাংলাদেশ ক্রিকেটের দিন বদলের স্বাক্ষী আপনি। একটা সময় ছিলেন জাতীয় দলের ভরসা। ১৮ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত কোনটা?
রাজিন সালেহ : আসলে অনেক মুহূর্তই আছে স্মরণ করার মত। তবে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়টা এখনো মনে পড়ে। এই সিরিজের এক তৃতীয়াংশ রান আমার ছিলো। এই সিরিজটা এখনো চোখে ভাসে। বিশেষ করে সিরিজের শেষ ম্যাচটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তখনকার কোচ ডেভ হোয়াটমোর বলেছিলো, রাজিন তুমি আউট হলে বাংলাদেশ হেরে যাবে। দেশের জন্য খেলবে না নিজের জন্য খেলবে? আমি বলেছিলাম অবশ্যই দেশের জন্য খেলবো। ইনশাল্লাহ আমি নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করবো। এবং আমি সফলও হয়েছি। টেস্টটা ড্র করতে পেরেছিলাম আর এজন্যই প্রথমবারের মত টেস্ট সিরিজ জিততে পেরেছি।
নিউজ ক্রিকেট ২৪ : জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পরে আর ডাক আসে নি। কি মনে হয়? এর কারণটা কি হতে পারে?
রাজিন সালেহ : এজন্য পারফর্ম এর কথা বলবো, পারফর্ম তেমন ভালো ছিলো না। জাতীয় দলে থাকা অবস্থায় রানের এভারেজ মোটামুটি ছিলো। তবে সেটা আমার বেলায়ই না। তখনকার সময়ের সকল প্লেয়ারদেরও আমার মত ২৪-২৫ কিংবা ৩০ এরকম এভারেজ ছিলো। তখন যদি আরেকটু সুযোগ দেওয়া হতো, আরো কিছুদিন জাতীয় দলে খেলতে পারতাম তাহলে আরো ভালো কিছু দিতে পারতাম।
নিউজ ক্রিকেট ২৪ : আপনি নিজে সিলেটের। আপনি ছাড়াও অলক কাপালি, তাপস বৈশ্য, এনামুল হক জুনিয়র, নাজমুল হোসেন সিলেটের ছেলে হয়ে অনেকদিন জাতীয় দলকে সার্ভিস দিয়েছেন। কি মনে হয় ভবিষ্যৎতেও আপনাদের মত কেউ জাতীয় দলের নিয়মিত মুখ হতে পারবে?
রাজিন সালেহ : গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। আমরা জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছি কারণ তখন আমরা অনেকগুলো ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতাম। বছরে ২৫টা ম্যাচও খেলেছি। কিন্তু এখন ছেলেরা সারা বছর প্র্যাকটিস করে ৪-৫টা ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়। আমি মনে করি সিলেটে ঘরোয়া ক্রিকেটে ম্যাচ সংখ্যা বাড়াতে হবে। বড় বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে। সুযোগ পেলে তবেই ছেলেরা নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নিবে।
নিউজ ক্রিকেট ২৪ : বাংলাদেশের একজন সাবেক অধিনায়ক আপনি। এই বিশ্বকাপের কথাই যদি আসে তবে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে টিম টাইগার্স। কোচিং স্টাফে এসেছে পরিবর্তন। এই দিকটা আপনি কিভাবে দেখছেন? আর টাইগাররা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?
রাজিন সালেহ : নতুন হেড কোচ নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করবো না কারণ উনি অনেক পরীক্ষিত আর অভিজ্ঞ। তবে আমি মনে করি দলের সিনিয়র জুনিয়র কম্বিনেশনে একসাথে চেষ্টা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মুশফিক, সাকিব, তামিম, রিয়াদ এদের ব্যাকআপ প্লেয়ার বাংলাদেশ দলে খুব কম। কাজেই তরুণ মেধাবী প্লেয়ারদেরকে সঠিক পরিচর্যার বিকল্প নেই। আর একটা সিরিজ খারাপ গেছে। সবারই খারাপ সময় যায় আর আবার ঘুরে দাঁড়ায়। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ তাদের পরবর্তী সিরিজেই আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
নিউজ ক্রিকেট ২৪ : সবশেষে আপনার পক্ষ থেকে টিম টাইগার্সের জন্য কোন ম্যাসেজ বা বার্তা?
রাজিন সালেহ : জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ক্রিকেট খেলাটা একটা বড় দায়িত্ব। নিজের দেশকে সততার সহিত রিপ্রেজেন্ট করতে হবে। আর মাশরাফির মত একজন অধিনায়ক বাংলাদেশকে একটি পরিবারের মত তৈরি করে দিয়েছেন। জুনিয়র প্লেয়ারদের ভেতর থেকে সেরাটা বের করে নিয়ে আসতে পেরেছেন। মাশরাফি একটি দল হিসেবে খেলতে শিখিয়েছে। সাকিব, মুশফিক, রিয়াদের মত প্লেয়ার আছে যারা দলকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার পক্ষ থেকে শুভকামনা বাংলাদেশের জন্য।
শুধু মাঠেই না, মাঠেই বাইরের রাজিন সালেহও কত গোছালো তার কথা শুনলেই বুঝা সম্ভব। কিন্তু তারপরেও তার চোখে মুখে চাপা অভিমানের ছাপ। একজন সাবেক অধিনায়কের বিদায়টা কি এমন হওয়া উচিত ছিলো? বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ওয়ানডেতে তৃতীয় সেঞ্চুরিয়ান রাজিন সালেহ। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে সব ধরনের ক্রিকেটকে গুডবাই জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু রাজিনই ছিলেন এদেশের ক্রিকেটের দিন বদলের স্বাক্ষী। একটা সময়ে ছিলেন জাতীয় দলের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম। নিজেই স্বীকার করলেন শেষের দিকটায় ব্যাটে তেমন রান ছিলো না। কিন্তু রান করার যে ক্ষুধা সেটা ঠিকই ছিলো। তার ব্যাটেই যে কেবল রান ছিলো না এমনটা না, তখনকার সময়ে দলের সবারই প্রায় একই অবস্থা। কিন্তু তাদেরকে তো এভাবে সারাজীবনের জন্য জাতীয় দল থেকে ছিটকে ফেলা হয় নি। তবে কেন রাজিন সালেহের বেলায়ই এমন নিয়ম? এমন প্রশ্নের উত্তর যেমন তার নিজেরও জানা নেই, তেমনি জানা নেই আমাদেরও। তখনকার বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে রাজিন ছিলেন সেরা ফিল্ডিংয়েও। ফিটনেস টেস্টে একমাত্র ক্রিকেটার ছিলেন যার ১০০ তে ১০০ মার্কস ছিলো। আরো কিছু সুযোগ দিলে হয়তো আজ হাসিমুখে বিদায় নিতেন, দলকে আরো অনেক কিছুই উপহার হিসেবে দিতে পারতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই ২০০৮ সালের পর জাতীয় দলের জন্য একবারও বিবেচনা করা হয় নি তাকে। ২০০৩ সালের আগস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে করাচিতে অভিষেক হয় রাজিনের।
বাংলাদেশের হয়ে ২৪ টেস্টে ১১৪১ রান তার, গড় প্রায় ২৬। এক দিনের ক্রিকেটে ৪৩ ম্যাচে ১০০৫ রান করেছেন ২৪ গড়ে। এবং একটি টি-টোয়েন্টিতে সুযোগ পেয়ে করেছেন ১১ রান। ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ারে ১৪২ ম্যাচে রান করেছেন ৮১৩৫, গড় ৩৫.৭। আর লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারে ম্যাচ খেলেছেন ১৪০টি। ১৪০ ম্যাচে ২৪.৬ গড়ে ৩১৫৩ রানের মালিক রাজিন সালেহ। রাজিন বিশ্বাস করেন দলকে আরো অনেক কিছুই দেবার সামর্থ্য ছিলো। কিন্তু ভাগ্যটা সাথে ছিলো না একদম। ঘরোয়া ক্রিকেটে দিনের পর দিন পারফর্ম করে গেলেও কোন লাভ হয় নি। আর সেই থেকেই তো ক্ষোভের সৃষ্টি। তবে রাগ বা অভিমান বোর্ডের উপর হলেও ক্রিকেট যে মিশিয়ে গেছে রক্তে। আর তাইতো এখন নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন ক্রিকেট কোচিংয়ের সাথে। একটি একাডেমীর ক্ষুদে ক্রিকেটারদের নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন এখন। বাংলাদেশের সাবেক এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার কোচ হিসেবেও নিশ্চয়ই সফল। রাজিন সালেহের মত আর যেন কোন প্রতিভা এভাবে হারিয়ে না যায় এমনটাই প্রত্যাশা ক্রিকেটপ্রেমীদের।