নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডেস্ক »
আপনি যদি একজন ক্রিকেট প্রেমী হয়ে থাকেন তবে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। ক্রিকেট প্রেমী অথচ স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে চিনেনা এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এবার কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান কে? তাহলে খানিক ভেবে অথবা না ভেবে মাথায় স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের নাম আস্তে বাধ্য। টেস্ট ক্রিকেটে ডন ব্র্যাডম্যান এমন একজন খেলোয়াড় যার গড় ৯৯.৯৪। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে হয়তো ১০০ গড় নিয়ে অবসরে যেতে পারতেন। কিন্তু শেষ ম্যাচে চার রান করতে পারেননি তাই সেই সুযোগ হয়নি। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে তার সময়কার সেরা খেলোয়াড় বললেন ভুল হবে। তিনি সর্বকালের সেরা। সেরার সেরা ডন ব্র্যাডম্যান। আজকে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের জন্মদিন। আজকে আমরা ডন ব্র্যাডম্যানের জানা অজানা সকল তথ্য নিয়ে আলোকপাত করবো।
ডন ব্র্যাডম্যান জন্মগ্রহণ করেন ২৭শে আগষ্ট ১৯০৮ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের কোটামুন্ড্রাতে। তার পুরো নাম ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান। তিনি ডানহাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন। তিনি লেগ ব্রেক বোলিং করতেন। যদি তিনি স্বীকৃত বোলার ছিলেন না। তার উচ্চতা ছিলো ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। তার কিছু ডাক নাম ছিলো সেগুলো হলো: দ্যা ডন, দ্যা বয় ফ্রম বোওরাল। ব্রাড্ডেলস। তার ক্রিকেটে যাত্রাপালা ১৯২৭-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। তার মধ্যে ১৯২৭-১৯৩৪ সাল অবধি তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে গেলেন। এই সময়ের মধ্যে ১৯২৮ সালে তার অষ্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের অভিষেক হয় ডন ব্র্যাডম্যানের। জাতীয় দলে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত খেলেন। আর ১৯৪৯ সালে সবধরনের ক্রিকেট ছেড়ে দেন। আর ১৯৩৫-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে সাউথ অষ্ট্রেলিয়া দলের হয়ে গেলেন। এই কিংবদন্তী ক্রিকেটার মৃত্যুবরণ করেন ২০০১ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি কেনসিংটন পার্ক, সাউথ অষ্ট্রেলিয়াতে। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিলো ৯২ বছর।
স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা করা যাক। এখানে তার আন্তর্জাতিক টেস্ট ও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করবো। প্রথমে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা করা যায়। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় ৩০শে নভেম্বর ব্রিসবেনে। অষ্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। আর টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান এই অষ্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৪ই আগষ্ট ওভালে। প্রথমে তার ব্যাটিং নিয়ে আলোচনা করা যাক: তিনি টেস্টে খেলেছেন: ৫২টি, ইনিংস: ৮০টি, অপরাজিত ছিলেন: ১০ বার, রান করেছেন ৬৯৯৬, ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ: ৩৩৪, গড়: ৯৯.৯৪, হাফ সেঞ্চুরি: ১৩, সেঞ্চুরি: ২৯, ডাবল সেঞ্চুরি: ১৩, বাউন্ডারি মেরেছেন: ৬৮১টি ও ওভার বাউন্ডারি মেরেছেন: ৬টি। এবার টেস্টে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের বোলিং পরিসংখ্যান দেখে নেয়া যাক। ৫২টি টেস্ট খেলে তিনি ৯টি ইনিংসে বোলিং করেছেন। যাতে ২৬.৪ ওভারে বোলিং করেছেন, রান দিয়েছেন ৭২, উইকেট নিয়েছেন ২টি, এক ইনিংসে সেরা বোলিং ফিগার: ১/৮, এক টেষ্টে সেরা বোলিং ফিগার: ১/১৫, গড়: ৩৬.০০, ইকোনমি: ২.৭০, স্ট্রাইক রেট: ৮০.০। ব্যাটিং বোলিং এর পাশাপাশি ফিল্ডিং এর ছোট্ট পরিসংখ্যান বাদ যাবে কেন? চলুন সেটিও দেখে নেয়া যাক। ৫২টি টেস্ট ম্যাচের ৯৯টি ম্যাচে প্রত্যক্ষভাবে ফিল্ডিংয়ে ছিলেন। যার মধ্যে ৩২টি ক্যাঁচ লুফে নিয়েছেন। এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ২টি ক্যাচ নিয়েছেন। আর ম্যাচ প্রতি তার ক্যাচের সংখ্যা: ০.৩২৩।
এবার আসা যাক স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট নিয়ে আলোচনায়। প্রথমে ব্যাটিং নিয়ে আলোচনা করা যাক। তিনি ২৩৪টি টেস্ট খেলেছেন, ইনিংস খেলেছেন: ৩৩৮, অপরাজিত ছিলেন: ৪৩ বার, রান: ২৮০৬৭, সর্বোচ্চ: ৪৫২*, গড়: ৯৫.১৪, হাফ সেঞ্চুরি: ৬৯, সেঞ্চুরি: ১১৭। এবার তার বোলিং নিয়ে আলোচনা করা যাক। তিনি ২৩৪ টেস্টে সর্বমোট ৩৫২.২ ওভার বোলিং করেছেন, যান দিয়েছেন: ১৩৬৭, উইকেট নিয়েছেন: ৩৬টি, সেরা বোলিং ফিগার: ৩/৩৫, গড়: ৩৭.৯৭। ইকোনমি: ৩.৮৭, স্ট্রাইক রেট: ৫৮.৭। এবার ফিল্ডিংয়ের পরিসংখ্যান দেয়া যাক। তিনি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বমোট ১৩১টি ক্যাঁচ নিয়েছেন এবং ১টি স্ট্যাম্পিং করেছেন উইকেট কিপার হয়ে। যদিও তিনি উইকেট কিপার নন।
ডন ব্র্যাডম্যান একদিনে সফল হননি। বরং তার শুরুটা ছিলো ব্যর্থতা দিয়ে। ১৯২৮ সালে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পুরো ক্যারিয়ার যতটা রঙিন তার চেয়ে বেশি অন্ধকার অভিষেক ও বিদায়ী ম্যাচ। ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ১৮ রান ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১ রান করে সাজঘরে ফেরেন। আর তার খারাপ করার ফলে তাকে পরের টেস্টে দলে রাখেনি। এমন বাজে শুরুর পর কেউ তাকে নিয়ে কেউ কল্পনা করতে পারেনি যে সে এতদূর আসতে পারবে। তৃতীয় টেস্টে আবারো দলে সুযোগ পান ডন ব্র্যাডম্যান। আর সুযোগ পাবার পর তাকে আর পিছে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন পড়েনি। এরপর যা করেছেন তা ইতিহাস। তার ক্যারিয়ারে তিনি মাত্র ৫২টি টেস্ট খেলেছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। এটা দেখে ভ্রু কুঁচকানোর প্রয়োজন নেই। এত কম খেলার কারণ রয়েছে। কারণ হলো ( ১৯৩৯-১৯৪৫ ) সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে খেলা হয়নি। আর লেখা হয়নি ডন ব্র্যাডম্যানের আরো ইতিহাস। তবে কম টেস্ট খেললেও তার রেকর্ড ভাঙ্গার সাহস কারো হয়নি। তিনি ৫২ টেষ্টে ২৯টি সেঞ্চুরি করেছেন। এটা দেখে মনে হতে পারে যে খুব কম। তবে তিনি এটি করেছেন মাত্র ৫২টি টেস্ট খেলে। যা বর্তমানের ক্রিকেটাররাও ভাঙ্গতে পারেনি। এই পরিসংখ্যান বাদ দিলেও আরেকটি দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে কেন ব্র্যাডম্যান সেরা। টেস্টে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি শচীন টেন্ডুলকারের। আর তার ইনিংসগুলো সেঞ্চুরিতে রূপান্তরের হার ১৫.৫০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কান গ্রেট কুমার সাঙ্গাকারার ৪.৭২ শতাংশ।আর ডন ব্র্যাডম্যানের ৩৬.২৫ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে ডন ব্র্যাডম্যান কেন সেরা।
এবার ডন ব্র্যাডম্যানের কিছু দানবীয় কীর্তির কথা জেনে নেয়া যাক:
- টেস্ট ক্রিকেট এক ধৈর্য্যর খেলা। এক টেষ্টে ৮০০+ রান করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তবে এমন কীর্তি আছে ৯ জন ক্রিকেটারের। যার মধ্যে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান আছেন। তবে বাকি ৮ জন একাধিকবার এই কীর্তি গড়তে পারেননি। যেখানে ব্র্যাডম্যান নিজে তিনবার এই কীর্তি গড়েছেন।
- স্যার ডন ব্র্যাডম্যান একদিনের মাঝেই ট্রিপল সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন।
এবার জেনে নেয়া যাক ডন ব্র্যাডম্যানের কিছু জানা ও অজানা তথ্য। এই তথ্য কারো জানা আবার কারো অজানা। চলুন দেখে নেয়া যাক সেই তথ্যগুলো:
১. ডন ব্র্যাডম্যান যখন স্কুলে পড়তেন তখন তার প্রিয় বিষয় ছিলো গণিত। প্রিয় হলেও তাতে নয় বরং ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
২. অষ্ট্রেলিয়াতে প্রতিটি প্রদেশে যে ক্রিকেট বোর্ডের অফিস আছে তার পোষ্ট বক্সের নাম্বার ৯৯৯৪। এটি করা হয়েছে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সম্মানে। কারণ তার ব্যাটিং গড় ৯৯.৯৪।
৩. নার্ভাস নাইনটিতে এসে আউট হয়ে যাওয়া ক্রিকেটে নতুন নয়। তবে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান কখনো নার্ভাস নাইনটিতে এসে আউট হননি।
৪. ডালিয়া ফুলের কথা সকলেই জানেন এই ফুলের বিশেষ জাতের নামকরণ করা হয়েছে ডন ব্র্যাডম্যানের নাম অনুসারে।
৫. স্যার ডন ব্র্যাডম্যান কখনোই কোনো ক্রিকেট একাডেমিতে গিয়ে অনুশীলন করেননি।
৬. ১৯৬০-১৯৬৩ ও ১৯৬৯-১৯৭২ সাল পর্যন্ত ডন ব্র্যাডম্যান অষ্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন।
৭. ডন ব্র্যাডম্যান প্রথম খেলেন বোওরাল স্কুল দলের হয়ে। সেই ম্যাচে ডন ব্র্যাডম্যান ১১৫ রানের নজরকাড়া ইনিংস খেলেন।
৮. ডন ব্র্যাডম্যান অষ্ট্রেলিয়ার হয়ে খেললেও তিনি খাঁটি অষ্ট্রেলিয়ান ছিলেন না। ইতালি থেকে প্রথম অষ্ট্রেলিয়া আসা পরিবারদের মধ্যে ডন ব্র্যাডম্যানের পরিবার একটি। তাই তাকে ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত বলা যায়।
৯. ১৯৩১ সালে একটি টেস্ট ম্যাচে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ১০০ রান করেন মাত্র ৩ ওভারে এবং সময় নেন মাত্র ১৮ মিনিট।
১০. ডন ব্র্যাডম্যানের এক প্রতিভা আছে ক্রিকেট ব্যতীত। আর তা হলো সঙ্গীতের। তিনি যদি ক্রিকেটার না হয়ে সঙ্গীতশিল্পী হতেন তাহলেও খারাপ করতেন না। ১৯৩০ সালে ” এভিরিডে আজ এ রেইনবো ডে পর মি ” নামে একটি গানের কম্পোজ করেন। আর পিয়ানোবাদক হিসেবে তার খ্যাতি আছে। তিনি পিয়ানোবাদক হিসেবে ” আওয়ার বাংলো অফ ড্রিমস ” ও ” অ্যান ওল্ড ফ্যাশন ” নামে দুইটি গান রয়েছে।
ডন ব্র্যাডম্যানের কিছু সম্মাননার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তার ” নাইটহুড ” উপাধি প্রাপ্তি। ক্রিকেটে ভূমিকা রাখার জন্য তাকে এই উপাধি দেয়া হয়। তিনি প্রথম অষ্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার যিনি এই উপাধি লাভ করেন।
এছাড়া উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরষ্কারটি তিনি একাই দশবার জিতেছেন। আর গ্যারি সোবার্স জিতেছেন আটবার। আর অন্য কোনো খেলোয়াড় তিনবারের বেশি জিততে পারেনি। ২০০০ সালে শতাব্দীর সেরা অষ্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড দলের অধিনায়ক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
স্যার ডন ব্র্যাডম্যান এখন হয়তো শারীরিক ভাবে জীবিত নেই। কিন্তু তার কীর্তি দ্বারা তিনি সকল ক্রিকেট প্রেমীদের মনে ঠিক জায়গা করে নিয়েছেন। এভাবে তিনি সকলের মনে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তার অমর কীর্তিগুলো ভাঙ্গা সহজ নয়। আর তার এই বিরল রেকর্ডগুলো তাকে চিরকাল মানুষের মনে বাঁচিয়ে রাখবে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি সেরা। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ” সেরার সেরা “।