কামরুল হাসান রাকিশ »
সময়কাল ২০০৫ সালের ১৮ই জুন-
কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন, পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। ২০০৩ বিশ্বকাপ জয় করে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হয়ে ক্রিকেট বিশ্বের সব দেশেই নিজেদের আধিপত্যকে সুদৃঢ় করেই চলেছে ক্যাঙ্গারুর দেশের ছেলেরা। অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড তখন রিকি পন্টিং নামক বিধ্বংসী এক ক্রিকেটশৈলী ফুটানো ব্যাটসম্যানের হাতে। বলা হয়ে থাকে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তথা ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা অধিনায়ক তিনি তখন। সেই ক্ষুরধার মস্তিষ্কের রিকি পন্টিং’ই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অজিদের। সেই অস্ট্রেলিয়াকে সেদিন হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে একরকম তুলকালাম কাহিনী সৃষ্টি করেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা, জয় করেছিল ক্রিকেটকে। ৭১ এর রক্তক্ষয়ী বিজয়ের পর পুরো বিশ্বকে আরও একবার জানান দিয়েছিল বাংলাদেশের সূর্যসন্তানেরা, জানান দিয়েছিল বাশার বাহিনী আমরা তৈরী হয়ে আসব নতুন সুরে, নতুন ভাবে, এই বিশ্ব একদিন আমাদের নিয়ে গর্ব করবে।
ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসের ২২৫০ তম ম্যাচ সেটি। তৎকালীন প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামছে হাবিবুল বাশার এর বাংলাদেশ দল। অস্ট্রেলিয়ার সেই দলের স্কোয়াড-টি মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। দুই দলের যোজন যোজন ব্যবধানটা ফুটে উঠবে এতেই। গিলক্রিস্ট – হেইডেন এর বিখ্যাত ওপেনিং জুটি। সাথে রিকি পন্টিং, ডেমিয়েন মার্টিন এবং মাইকেল ক্লার্ক। এর সাথে মিস্টার ক্রিকেট মাইক হাসি এবং সাইমন ক্যাটিচ। বোলিং আক্রমণে সেদিন ছিলেন বোলিং লিজেন্ড গ্লেন ম্যাকগ্রা, সাথে ছিলেন জ্যাসন গিলেস্পি, মাইকেল ক্যাচপ্রোইজ এবং ব্র্যাড হগ। এদিকে বাংলাদেশে তখন বলার মত নাম কেবল মোহাম্মদ আশরাফুল ও মাশরাফি মোর্ত্তজা।
২০০৫ সালের ১৮ জুন, কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে টস জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নেয় অস্ট্রেলিয়া। দলের পেস ভরসা মাশরাফির হাতে নতুন বল তুলে দেন টাইগার অধিনায় হাবিবুল বাশার। দুর্দান্ত পেস এবং নিখুঁত লাইন ল্যান্থে শুরুতেই কাঁপন ধরাণ ক্যাঙ্গারু শিবিরে। ইনিংস এর দ্বিতীয় বলেই শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন অজি ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে।
ক্রিজে আসেন রিকি পন্টিং। এবার শিকারীর ভূমিকায় তাপস বৈশ্য। তাতে অস্ট্রেলিয়ার কি এসে যায়। লম্বা ব্যাটিং লাইনআপ তাদের। ডেমিয়েন মার্টিন এর ৭৭, মাইকেল ক্লার্ক এর ৫৪ এবং শেষ দিকে মাইক হাসি ও ক্যাটিচ এর ঝড়ো ব্যাটিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৫০ ওভারে ২৪৯ । মাশরাফি সেই ম্যাচে ১০ ওভারে ৩৩ রান দিয়েছিলেন মাত্র। অবশ্য ২০০৫ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে ২৫০ রান অনেক বড় লক্ষ্যমাত্রা। আর বাংলাদেশ এর এত বেশি রান তাড়া করে এর আগে কোন জয়ের রেকর্ডই নেই। তখন বাংলাদেশ এর জন্য ২০০ রান করাই সম্মানজনক স্কোর কিংবা পুরো ৫০ ওভার ব্যাটিং করাই মানে দলের মান বাঁচানো।
হয়তো দলের মান বাঁচাতেই ব্যাটিং এর হালখাতা খুলতে ক্রিজে এসেছিলেন জাভেদ ওমর বেলিম এবং বর্তমান জাতীয় দলের ওপেনার তামিম ইকবালের বড় ভাই নাফিস ইকবাল। সেই সময় বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। কেউ কেউ তাকে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাবান বলেও দাবি করেন। তাঁর ব্যাটিং ছিলো দেখার মতো। দৃষ্টিনন্দন স্টাইলিশ সব শট এর কালেকশন। এই কারণেই বোধহয় কেউ কেউ জাভেদ ওমর এর বিখ্যাত ডিফেন্সিভ ব্যাটিং এর সমালোচক ছিলেন। কারণ জাভেদ ওমর আউট হলেই ব্যাটিং এ আশরাফুল এর নামার পথ সুগম হয় যে! জাভেদ ওমর সেদিনও খেলছিলেন তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। ৫১ বলে তার অর্জন ১৯ রান। খালি চোখে সমালোচনা করার মতই মনে হবে। তবে তখনকার সময়ে ম্যাকগ্রা, গিলেস্পিদের সামাল দিতে এই ৫১ বল খেলে আসতে পারাটাই বড় অর্জন। এর আগেই নাফিস ইকবালের উইকেট হারায় বাংলাদেশ। নাফিস ২১ বলে ৮ রান করে আউট হন। তুষার ইমরান তিন নম্বর খেলতে এসে কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন বটে। ৩৫ বলে ২৪ রান করে তিনিও আউট হয়ে যান। কিন্তু তুষারের সেই মাঝারি ইনিংস একটু হলেও সাহস যুগিয়েছে আশরাফুল-বাশারদের।
৭২ রানেই তিন উইকেট নেই বাংলাদেশের। অর্ধেক ইনিংস মানে ২৫ ওভার শেষে স্কোর মাত্র ৮১ রান। ২৫০ রানের লক্ষ্যকে তখন পাহাড়সমই মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশী ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে। অনেকেই তাই অন্যসব দিনের মতো আশংকায় ছিলেন আরো একটি পরাজয়ের। কেউ কেউ টিভি সেট অফ করে দিয়েছেন অথবা চ্যানেল ঘুরিয়ে শীর্ষ রাজনৈতিক খবর দেখছিলেন। তাদের জন্য একরাশ হতাশাই অনুভব হওয়া উচিৎ। কারণ তারা হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি কি অকল্পনীয় একটি মুহুর্ত উপহার দিতে চলেছে টাইগার বাহিনী। আরো আলাদা করে বললে বলতে হয় মোহাম্মদ আশরাফুলের কথা।
ক্যাপ্টেন হাবিবুল বাশার এবং আশরাফুল মিলে গড়লেন ১৩০ রানের বিশাল জুটি। মোহাম্মদ আশরাফুল খেললেন এক মহাকাব্যিক ইনিংস। স্বভাবের বাইরে গিয়ে মাথা গরম করে অকাতরে উইকেট বিলিয়ে আসা আশরাফুলকে দেখা গেলো অন্য এক রুপে। বলের গুণ বিবেচনা করে খেলছিলেন সেদিন। মাঝে মধ্যেই দর্শনীয় কাভার ড্রাইভ, পুল শট অথবা হুক শট অবলীলায় খেলছিলেন লিটল মাস্টার। ধারাভাষ্যকাররা প্রতিভাবান আশরাফুল এর “চিকি” শটের প্রশংসা করছিলেন সবচেয়ে বেশি। এভাবে এগিয়ে যেতে যেতেই ঠিক ১০০ বলে করলেন ১০০ রান।
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের প্রথম শতক। সব দর্শকের করতালিতে মুখর কার্ডিফের মাঠ। অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়রা অভিনন্দন জানাতে ভুল করেননি আশরাফুলকে। আশরাফুল মাঠেই সিজদা দিলেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়ার যেন শেষ নেই তাে। সেই ঐতিহাসিক দিনে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে সিজদা দেওয়া দৃশ্যটি আজও হাজারো জাদুঘর কিংবা শোরুমে বাঁধাই করা থাকবে।
“পিকচার আভি বাকি হ্যে মেরা দোস্ত” ! খেলা এখনো শেষ হয়নি। বাশারের পর এবং শতক হাঁকানোর পরের বলেই আশরাফুল এর আউট ম্যাচ এর মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তখনো আফতাব আহমেদ ব্যাটিং এ ছিলেন আর তাঁর সাথে মোহাম্মদ রফিক। আফতাব আহমেদ সেই সময়ে দলের অন্যতম সেরা হার্ড হিটার ছিলেন। যিনি নিজের দিনে অবলীলায় যেকোনো বোলারের উপরই ধ্বংসলীলা চালাতেন। ম্যাচ এর শেষ ওভারটিতে তিনি মোকাবেলা করবেন গিলেস্পিকে। ৬ বলে ৭ রানের দরকার। বল করার পরপরই আফতাব আহমেদ ক্রিজ থেকে হালকা বাম দিকে সরে এসে ব্যাট ঘুরিয়ে দেন মিড উইকেট এর দিকে। বল হাওয়ায় ভাসছে। গিলেস্পি তাকিয়ে আছেন,রিকি পন্টিংও দেখছেন বলের গন্তব্য কোথায় যাচ্ছে। অতঃপর বল সীমানার বাইরে। ছক্কা !!
পরের বলেই এক রান নিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে নোঙ্গর করান আফতাব আহমেদ। সেই অনুভূতি বলে বোঝানোর নয়। গা কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো। একজন বাংলাদেশী হিসেবে সেই রাতে জাগ্রত সব দর্শক এটিকে ভেবেছিলো নিজের জয়। এটিই বিশ্বজয়ের চেয়ে কম কিছু নয়।
এখন পর্যন্ত এটি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র বিজয়। সেই অস্ট্রেলিয়া দলের মাশরাফি ব্যতিত কোনো সদস্যই এখন বর্তমান জাতীয় দলে নেই। সেই বাংলাদেশ দলের চেহারাও এতদিনে পালটে গেছে। একমাত্র সদস্য হিসেবে টিকে আছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। যিনি দলের উত্থান-পতন উন্মাদনা আর আর কত ঐতিহাসিক বিজয়ের রাজসাক্ষী! এখন ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের দলে জায়গা পাওয়া নিয়েই কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। বোলিংয়ে পেস আক্রমণ বিশ্বের মধ্যেই সেরাদের কাতারে পড়ে। আবার বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার রয়েছেন আমাদের দলে। তাই এখনকার সময়টায় ম্যাচজয় আমাদের অভ্যাসেই পরিণত হয়েছে। এখন আর রিকি পন্টিং এর উত্তরসূরীরা আমাদের বিরুদ্ধে হেসে খেলে জিতে যাবে এটা ভাবতে পারে না। তাদের বলতে হয়, “বাংলাদেশ আর প্লেয়িং ওয়েল,উই হ্যাভ টু প্লে আওয়ার বেস্ট টু ডিফিট দেম…”
ম্যাচশেষে তো অধিনায়ক রিকি পন্টিং বলেই বসলেন- “Probably the biggest mishap in the history of cricket, my worst loss as a captain”
সেই থেকে হলো শুরু, আজও বাংলাদেশ ক্রিকেট লাগামহীন ভাবে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বে। কে জানতো এই বাংলাদেশের উত্থান-পর্ব আর নবজাগরণ হয়ত অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই জয় থেকেই শুরু হয়েছিলো। এভাবেই হয়তো একদিন সোনার ট্রফিটিও ছিনিয়ে আনবে বাংলার দামাল ছেলেরা।