আমি বাঙালি, আমি দেশের হয়ে খেলতে চাই: আসিফ  মাহমুদ

জাকির মামুন »

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেড়ে উঠেছিলেন আসিফ মাহমুদ। শৈশব-কৈশোরের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছেন ক্রিকেট খেলে। পাড়ার ক্রিকেটে আসিফ মাহমুদ পরিচিত  ছিলেন একজন মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে।  দ্রুত গতিতে বল করায় আসিফকে সমীহ করতো সবাই। এলাকা টুর্নামেন্টগুলোতে আসিফকে দলে ভেড়াতে শুরু হতো কাড়াকাড়ি। মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে চলে গেলেন আমেরিকার নিউইয়র্কে। বাবা মার স্বপ্ন ছিল আসিফ ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবে। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও আসিফের ধ্যান-জ্ঞান ছিল শুধুই ক্রিকেট। তাই বাবা-মার বাধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়তই ক্রিকেট খেলে গেছেন আসিফ। নিউইয়র্কে স্কুল ক্রিকেট ও কলেজ ক্রিকেটে তিনি দেখিয়েছেন তার পারদর্শিতা ও রেখেছেন মেধার যথার্থ স্বাক্ষর। ৬ ফিট  ১ ইঞ্চি লম্বা তরুণ ছেলেটি গড়ে ১৩৫+ কিঃমিঃ/ঘন্টায়  বল করতে পারে। ব্যাট হাতে ও দুর্দান্ত কার্যকরী ইনিংস খেলার সক্ষমতা রয়েছে তার। ফাস্ট বোলার অলরাউন্ডার হওয়ায় অনেকের নজরে আসে আসিফ মাহমুদ।

যদিও নিউইয়র্কে থাকেন তবে মন পড়ে থাকে এদেশের ক্রিকেটের মাঝেই। দেশে এসে সুযোগ পেয়ে ফাস্ট ডিভিশন এর কয়েকটি ম্যাচ খেলেছেন মোহাম্মদপুর ক্লাবের হয়ে। বিপিএলে খুলনা টাইগার্স এর হয়ে অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছেন। এবার একটি ক্লাবের হয়ে খেলার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা এখন স্থগিত।

এই  সংকটকালীন  সময়ে নিউইয়র্কে পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছেন আসিফ। নিউইয়র্ক  থেকে ক্রিকেট নিয়ে নিজের পরিকল্পনা ও সমসাময়িক বিভিন্ন  বিষয় নিয়ে তিনি  কথা বলেছেন আমাদের প্রতিবেদক জাকির মামুনের সাথে।

নিউজক্রিকেট২৪ : আমেরিকার নিউইয়র্কে করোনার প্রভাব অনেকটা বেশি। কোন ধরনের উদ্বিগ্নতা কিংবা উৎকণ্ঠা কাজ করছে?

আসিফ মাহমুদ : তা তো অবশ্যই। এখানে অনেক বাঙালি মারা গেছে। এতে আমি খুব বেশি ব্যথিত ও মর্মাহত। পুরো সময়টা ঘরেই পার করছি।

নিউজক্রিকেট২৪:  কিভাবে  সময় কাটাচ্ছেন?

আসিফ  মাহমুদ : পরিবারের  সবার সাথে সময় কাটাচ্ছি।  বাংলাদেশ জয় পাওয়া ম্যাচ গুলোর হাইলাইটস দেখছি।ভিডিও ফুটেছে  বিভিন্ন  প্লেয়ারদের ব্যাটিং  কৌশল গুলো দেখছি। আর নিজেকে ফিট রাখতে কিছু ব্যায়াম করছি।

নিউজক্রিকেট২৪ : পাড়ার ক্রিকেটার থেকে আজ পেশাদার  ক্রিকেটার। কিভাবে এটা সম্ভব  হয়েছে?

আসিফ মাহমুদ : অনেকের মত আমার ও স্বপ্ন ছিলো  ক্রিকেটার  হওয়ার। কিন্তু সেটা কঠিন  ছিলো। বাবা মা কখনো  চান নাই আমি খেলা-ধুলা করি। এসএসসি পাশ করে এইচএসসি দেওয়ার আগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকায় চলে আসি। ২০১৫ সালে স্কুল ক্রিকেট দিয়ে আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু হয়।  সেরা পাচ  অলরাউন্ডার মধ্যে আমি একজন ছিলাম। যার ফলস্বরূপ ২০১৫’র নভেম্বরে অলস্টার ক্রিকেট গেমের লিজেন্ডারি প্লেয়ারদের সাথে প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাই। যেখানে  লারা, সচিন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরামদের মত  তারকারা ছিলেন। তখন থেকেই  নতুন করে আবার  ভালো লাগা সৃষ্টি হয়।

২০১৬ সালে ও স্কুল ক্রিকেটে আমার পারফরম্যান্স ছিল দেখার মতো।  স্কুল ক্রিকেটের সেরা সেরা প্লেয়ারদের কে নিয়ে  ” Best in the City” নামক একটি ম্যাচ  হয় যেখানে আমার ও খেলার সৌভাগ্য হয়।  তখন থেকে আমি সবার নজরে আসতে শুরু করি।  নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসি ফ্লোরিডা, নিউজার্সি,প্যানসেলভেনিয়া সহ বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ হয়। ২০১৬ সালে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিপিএলে আমার দল চ্যাম্পিয়ন হয় যেখানে আমার অলরাউন্ডিং পারফরম্যান্স ছিল দেখার মতো।  ব্যাটে বলে দুটোতেই সেরা তিনে ছিলাম। ২০১৭ সালে নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ক্রিকেট লীগে আমার দল চ্যাম্পিয়ন হয়। ওখানেও আমি টপারে ছিলাম। ওই বছরেই নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত বাঙালি লীগে সেরা একাদশে ছিলাম।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ টিম যখন আমেরিকাতে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে খেলতে, তখন ফ্লোরিডায় বাংলাদেশ টিমের সাথে আমি প্র্যাকটিস করি। উনাদের সাথে অনুশীলন করে আমি অনেক কিছু শিখতে পারি। আর ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা আরো বেড়ে যায়। দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন টা বুনতে থাকি। এই বছরেই নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত বিপিএলে ইনজুরির কারণে নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতে পারেনি।  তবুও দমে যায়নি। সুস্থ হয়ে আবার শুরু করি সংগ্রাম।

২০১৯সালে আমেরিকার গ্লোবাল টিমে আমার সুযোগ হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাকো তে   টুর্নামেন্টটি অনুষ্ঠিত হয়। ওখানে আমাদের টিমের কোচ ছিলো শিবনারায়ন চন্দরপল। পাঁচ ম্যাচ সিরিজের মধ্যে আমার এক ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়।  সেখানে আমি শুধু ব্যাটিংয়ের সুযোগ  পাই। ব্যাটিংয়ে ভালোই করেছিলাম। ওই টুর্ণামেন্টে ভালো করা প্লেয়াররা সিপিএলের সুযোগ পায়। আমারও সুযোগ হয় ওখানে।  যেখানেই  ইউএসএ ন্যাশনাল টিমের ৩, ৪ জন ছিলো।
টুর্ণামেন্টে বিভিন্ন দেশের কিছু সেরা টিম ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলের পাঁচজন খেলোয়াড় খেলেছিলো। তাদের সাথে খেলার সৌভাগ্য হয়।আমি অনেক কিছু শিখতে এবং জানতে পারি।

নিউজক্রিকেট২৪ :  বাংলাদেশে খেলার সুযোগ হয় কবে?

আসিফ মাহমুদ: ২০১৯ সালে ফার্স্ট ডিভিশনে। প্রথম খেলার অভিজ্ঞতা হিসেবে মোটামুটি ভালই খেলেছি।  দুইটি টি-টোয়েন্টি খেলি। আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেকটা অসুস্থ হয়ে যাই। বেশ কিছুদিন  পর বাংলাদেশ  জাতীয়  দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে দুইটি প্রস্তুতি মুলক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। একজন কোচের সহায়তা সেখানে আমার খেলার সুযোগ হয়। প্রথম ম্যাচে দুই ওভার বল করে বারো রান খরচায় ১ উইকেট  নিই। ক্যাচ না মিস হইলে আরও একটি উইকেট পেতাম(হা হা হা)।  দ্বিতীয় ম্যাচে ৩ ওভার বল করে একটি উইকেট নিই। দুর্দান্ত একটি ক্যাচ  ও নিয়েছিলাম(হাহাহা)।
আমার খেলা ভালো লেগেছে তাই হয়তো বিপিএলে খুলনা টাইগার্সের সাথে অনুশীলন করার  সুযোগ করে দেয়।  মুশফিক ভাই, শামসুর রহমান শুভ ভাই, আমির, রুশো, ফ্রাঙ্কলিন এর সাথে প্র্যাকটিস করার কারণে অনেক কিছু শিখেছি। দেশি-বিদেশি অনেক প্লেয়ারকে কাছ থেকে দেখেছি অনেক কিছু শিখেছি তাদের কাছ থেকে।

নিউজক্রিকেট২৪ : ইনজুরিতে পড়লেন কিভাবে ?

আসিফ মাহমুদ : ফার্স্ট ডিভিশন এর একটি ওয়ানডে ম্যাচ ব্যাটিং  করার সময় একটি বল মাথায় সজোরে আঘাত হানে। একটু বেশি সমস্যা ফিল করায়,  ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে এরপর না খেলে ইউএসএ তে চলে আসি। করোনার প্রাদুর্ভাব কমে গেলে আবার ইনশাল্লাহ বাংলাদেশে আসবো। চিটাগাং প্রিমিয়ার লিগ একটি টিমের সাথে কথা হয়েছে। পরিস্থিতি ভালো হলে তাদের টিমের খেলার সম্ভাবনা আছে।

নিউজক্রিকেট২৪ :  ধরুণ বাংলাদেশ  ও আমেরিকা  দুটো দলের খেলার সক্ষমতা আছে আপনার।  তাহলে আপনি কোন দলে খেলতে চাইবেন?

আসিফ মাহমুদ : অবশ্যই বাংলাদেশের হয়ে। আমি বাঙালি,বাংলাদেশের হয়ে খেলতে চাই।

নিউজক্রিকেট২৪ : ক্রিকেটার হতে কোন কোচের ভূমিকা বেশি ছিল?

আসিফ মাহমুদ :  আসলে আমি কোন কোচের আন্ডারে খেলা শিখিনি। নিজে নিজে এতোটুকু শিখেছি। তবে হ্যাঁ, ভালো কোচ পেলে আমি ভালো কিছু করতে পারবো  আশা রাখি। টেকনিক, স্কিলের উন্নতি করতে কোচের বিকল্প নেই। বিসিবি থেকে যদি কোচিং, ট্রেনিং এর সুযোগ  পাই সেটা আমার জন্য সবচেয়ে  মঙ্গল হবে বলে আমি মনে করি।

নিউজক্রিকেট২৪:  প্লেয়ারদের জন্য ফিটনেস টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে ফিটনেস ঠিক রাখতে আপনি কি করছেন?

আসিফ  মাহমুদ:  আসলে প্রথমদিকে ফিটনেসের বিষয়টি  অতটা  মাথায় ছিল না। ফিটনেস ছাড়া খেলা চালিয়ে যাওয়াটা যে কোন প্লেয়ার এর জন্য খুব কঠিন। তাই বর্তমানে ফিটনেসের ব্যাপার আমি খুবই মনোযোগী। তাই ফিটনেস ঠিক রাখতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। খাবার ও এনেছি পরিবর্তন।

নিউজক্রিকেট২৪ :  ক্রিকেটে কাকে অনুকরণ করেন কিংবা আদর্শ মানেন?

আসিফ মাহমুদ  :  ব্যাটিং এ ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে আর বোলিংয়ের শোয়েব আক্তার,  ব্রেটলিকে অনুসরণ করি। তবে মাশরাফি ভাইকে আমি অনেক পছন্দ করি। একজন প্লেয়ারের পাশাপাশি  তিনি একজন অসাধারন মানুষ।

নিউজক্রিকেট২৪ :  অবসরে কি করতে ভালোবাসেন?
আসিফ মাহমুদ : কার রাইডিং  করতে ভালোবাসি বিশেষ  করে স্পোর্টস কার রাইড করতে। এছাড়াও বন্ধুদের  সাথে  ঘুরতে ও আড্ডা  দিতে ভালো  লাগে।

নিউজক্রিকেট২৪ : সব প্লেয়ারদের  ব্যক্তিগত লক্ষ্য থাকে। আপনার ব্যক্তিগত লক্ষ্য কি?

আসিফ মাহমুদ:  বাংলাদেশ জাতীয় দলের খেলা। বিশেষ করে প্রথমে টি-টোয়েন্টি ফরমেটে সুযোগ করে নেওয়া। কেনোনা আমি দ্রুতগতিতে রান করার পাশাপাশি দ্রুতগতি তে বল করতে পছন্দ করি।

নিউজক্রিকেট২৪ :  করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯  নিয়ে আপনার বক্তব্য কি?

আসিফ মাহমুদ :  দেখুন, এটি বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নিয়েছে। আমার দেশ বাংলাদেশের অবস্থা ও  ভালো নেই।  সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। সরকার ও  স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিধি-নিষেধ গুলো মেনে চলা উচিত। এই সংকটকালীন মুহূর্তে সবাইকে বিশেষ করে  বিত্তবানদের উচিৎ  দিনমজুর, কর্মহীন ও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। আসুন আমরা সবাই মানবিক হওয়ার চেষ্টা করি।

নিউজক্রিকেট২৪ : আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার জন্য রইলো শুভকামনা।

আসিফ মাহমুদ:  আপনাকে এবং নিউজক্রিকেট২৪ পরিবার ও পাঠক সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »