শুভ জন্মদিন আব্দুর রাজ্জাক রাজ

কামরুল হাসান রাকিশ »

বাংলাদেশ ক্রিকেটে শাসন করতে যত নামীদামী ক্রিকেটার এসেছেন, যাদের ক্রিকেটীয় ভাবমূর্তিতে এদেশের ক্রিকেট হয়ে উঠেছে সাফল্য থেকে সাফল্যমন্ডিত। ক্রিকেট বিশ্ব দরবারে নিজেদের বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক অনন্য চূড়ায়, যেকজন ক্রিকেটারের নাম এই তালিকায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁদের মধ্যে অন্যতম, তাঁদের মধ্যে বিশেষ ব্যক্তিত্ব, তাঁদের মধ্যে মানসম্মত একজন ক্রিকেটার নাম তাঁর আব্দুর রাজ্জাক রাজ।

বাংলা সিনেমাকে একসময় যেমন নিজের রাজ্য শাসনের মত শাসন করেছেন নায়ক রাজ রাজ্জাক ঠিক তেমনি করেই বাংলার ক্রিকেটে নিজের আধিপত্যকে অনন্য নিদর্শনের চূড়ায় শাসন করা একজন বামহাতি অর্ধড্রোক্স বোলার সে খান আব্দুর রাজ্জাক। ডাকনাম রাজ।

জন্ম ঠিক আজকের এইদিনে সালটা ১৯৮২ সাল। খুলনা জেলার এক মনোরম পরিবেশে এক সনামধন্য মুসলিম খান পরিবারে জন্ম তাঁর। ছোট বেলা থেকেই খেলা খেলা করে ছেলেটি তাঁর সর্বস্ব সময় অতিবাহিত করেছেন। খুলনা বিভাগীয় ক্রিকেট দলের পক্ষে ২০০১-২০০২ মৌসুমে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট পর্যায়ে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন। এরপর আর তাঁকে পিছনে পিরে তাকাতে হয়নি, একের পর এক সাফল্য লাভ করে বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক অন্যতম ভরসার নাম হয়ে উঠেছিলেন বাংলা ক্রিকেটের রাজ, খান রাজ্জাক।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কর্তৃপক্ষ রাজ্জাককে ২০০৪ সালের জুলাই মাসে অণুষ্ঠিত এশিয়া কাপ ক্রিকেটে হংকংয়ের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটায়। তিনি দলে নিজেকে তার যথোপযুক্ততা নিয়মিতভাবে প্রকাশ ঘটান; কিন্তু ১ম একাদশে স্থায়ীভাবে আসন গড়তে পারেননি। ২০০৬ সালের মে মাসে আব্দুর রাজ্জাক ২০০৫-২০০৬ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অণুষ্ঠিত ২য় টেস্টে নিজ অভিষেক ঘটান।
অতীতে ঘরোয়া ক্রিকেটে বোলিং করার সময় রাজ্জাক থ্রো বা চাকতি নিক্ষেপের অভিযোগে বেশ কয়েকবার অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এরই রেশ ধরে ২০০৪ সালে অণুষ্ঠিত এশিয়া কাপের খেলায় আইসিসি’র ম্যাচ রেফারি রোশন মহানামা কর্তৃক তিনি পুণরায় অভিযুক্ত হন এবং তাকে বোলিং ভঙ্গীমা পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। পরবর্তীকালে রাজ্জাক বোলিংয়ে ধরন পরিবর্তন করে বৈধভাবে বোলিং করে আস্থা অর্জন করেন। ফলে, আবারো তিনি নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক দলে ফিরে আসলেও তাড়াতাড়ি তার নিজস্ব ছন্দ খুঁজে পাননি। কিন্তু ধীরে ধীরে পুণরায় তিনি ধারাবাহিকভাবে ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করে জাতীয় দলের একজন নিয়মিত সদস্য খেলোয়াড় হয়ে নিজেকে গড়ে তোলেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশী বোলার হিসেবে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২০০ উইকেট নেন।

ওয়ানডে ক্রিকেটে সফলতার পর আব্দুর রাজ্জাক নিজ দেশে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়া’র বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক ঘটান। বাংলাদেশের পক্ষে তার ১ম টেস্ট অভিষেকে ১৫ রান করেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র ইনিংসে বোলিংয়ের সুযোগ পেলেও কোন উইকেট নিতে সক্ষম হননি রাজ্জাক। স্বভাবতঃই দল পরাজিত হয়। পরের টেস্ট খেলার সুযোগ আসে দীর্ঘ এক বছর পর শ্রীলঙ্কা’র বিপক্ষে। চামারা সিলভাকে কট আউটের মাধ্যমে তার ১ম উইকেট প্রাপ্তির সুযোগ ঘটে। এছাড়াও তিনি গ্রেইম স্মিথের দক্ষিণ আফ্রিকা দলের বিপক্ষে টেস্টের উভয় ইনিংসে সর্বোচ্চ ৩৩ রান করেন; তন্মধ্যে একবার অপরাজিত থাকেন। নিউজিল্যান্ড দলের বিপক্ষে তার টেস্ট সেরা বোলিং পরিসংখ্যান দাঁড় করান ৯৩ রানের বিনিময়ে ৩ উইকেট। এই টেস্ট-সহ সিরিজের পরের টেস্টেও তার বোলিং ভঙ্গীমা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকে।

আব্দুর রাজ্জাকই হচ্ছেন বাংলাদেশের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত আইপিএল বা ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে খেলেন। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর দল তাকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় এবং একটিমাত্র খেলায় অংশগ্রহণ করায়। ঐ দলের পক্ষে বাকী কোন খেলায় অংশগ্রহণ না করলেও রাজ্জাক বিশ্বাস করেন যে, টুর্নামেন্টের অভিজ্ঞতাই গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য বিষয় এবং তাঁর জন্য পথ ও পাথেয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেন যে, টেস্ট ম্যাচে বোলিংয়ের বিষয়ে ভারতীয় তথা বিশ্বসেরা স্পিনার অনিল কুম্বলে তাকে বিরাটভাবে সহযোগীতা করেছেন এবং অনিলের বোলিং অণুসরণ করতে বলেছেন। কেবলমাত্র নিখুঁত লাইন এবং লেন্থে বোলিং করেই একজন বোলার তার কাঙ্খিত সাফল্য বয়ে নিয়ে আসতে পারেন। প্রকৃতপক্ষেই অধিনায়ক যখন খেলায় পুরোদমে ফিরে আসতে চান তখন আমাকেও বোলিংয়ে কোনরূপ পরিবর্তন না এনে অগ্রসর হতে হবে এবং উইকেট থেকে সহায়তা পেয়ে ব্যাটসম্যানকে আউট করা বেশ সহজ হয়ে পড়ে। – রাজ্জাকের অভিমত। এছাড়াও, কোচ ভেঙ্কটেশ প্রসাদও তাকে যথেষ্ট সহায়তা-সহ ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেছেন বলে উল্লেখ করেন আব্দুর রাজ্জাক।

ভালো কিছু করলে সবার নজর কাড়ে এটা চিরন্তন সত্য, সেই ধারাবাহিকতায় আব্দুর রাজ্জাকও নিষেধাজ্ঞার স্বীকার হয়েছিলেন। সময়টা অক্টোবর ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে বাংলাদেশ সফরে খেলতে এলে সন্দেহজনক বোলিং এ্যাকশন হিসেবে ড্যারিল হার্পার এবং অশোকা ডি সিলভা – আম্পায়ারদ্বয় তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। বোলিং এ্যাকশনের ব্যাপারে এটি ছিল আব্দুর রাজ্জাকের ক্রিকেট জীবনে ২য়বারের মতো ঘটনা। একজন বোলারের নিক্ষেপকৃত বল যদি তার কনুইয়ের ১৫ ডিগ্রীর বেশি হয় তখন তা চাকতি বা চাকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। লক্ষ্য করে দেখা গেছে যে, রাজ্জাকের যে সকল বল খুব বেশি দ্রুতবেগে নিক্ষিপ্ত হয় তখনই কেবলমাত্র বলটি গ্রহণযোগ্য হয় না।

এছাড়াও, টেস্টে রাজ্জাকের স্বাভাবিক বোলিংয়ের সময় কনুই বাঁকা হয় ২২–২৮ ডিগ্রী; গড়ে ২৫– ডিগ্রী এবং দ্রুতগামী বলগুলোতে এই বাঁকের গড় হার ২৪–। ফলাফলস্বরূপ তাকে সাময়িকভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গণ থেকে নিষিদ্ধ হতে হয়।
২০০৯ সালের জুলাই মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজে সফরের মাধ্যমে নিষিদ্ধাবস্থা থেকে রাজ্জাক পুণরায় বাংলাদেশ দলের পক্ষে ১ম বারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গণে প্রত্যাবর্তন করেন। টেস্ট দলের সদস্য না হলেও একদিনের ক্রিকেট সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে মাঠে খেলতে নামেন।

রাজ্জাকের অসাধারণ ক্রীড়ানৈপুণ্যে ১ম ওডিআইয়ে বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৫২ রানে পরাজিত করে। সে ম্যাচে রাজ্জাক ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন। বল হাতে রাজ্জাকের ৩৯ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট লাভ করা ছিল বিপক্ষীয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের বিরোধের জেরের ফসল। রাজ্জাক ক্যারিবীয় দলের বিরুদ্ধে ৩ ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেটধারী বোলার হন। সিরিজ শেষে তিনি ২২.৮৫ রান দিয়ে ৭ উইকেট নিলেও শেষ খেলায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। হাঁটুর এ আঘাতের দরুন তিনি আগস্ট, ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে দল থেকে বাদ পড়েন।

এর কিছুদিন পর অক্টোবর-নভেম্বর, ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল ৫ ম্যাচের ওডিআই সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে আসে। রাজ্জাক আঘাতজনিত অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেয়ে পুণরায় বাংলাদেশ দলে স্থান করে নেন। রাজ্জাক এই সিরিজে বাংলাদেশকে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জিততে সহায়তা করেন। ১৫ উইকেট নিয়ে তিনি ম্যান অব দ্য সিরিজ নির্বাচিত হন।

ক্রিকেটে ফিরে আসার পর বিশ্বব্যাপী ওয়ানডে ক্রিকেট রেটিং পদ্ধতিতে বাংলাদেশীদের মধ্যে ১মবারের মতো রাজ্জাক সাকিব আল হাসানকে টপকে সর্বোচ্চ র‌্যাঙ্কে পৌঁছার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন। ২৩ জানুয়ারি, ২০১১ পর্যন্ত বোলার হিসেবে – আব্দুর রাজ্জাকের র‌্যাঙ্ক ৩ এবং সাকিব আল হাসানের র‌্যাঙ্ক ৬ (অল-রাউন্ডার হিসেবে সাকিবের বর্তমান অবস্থান ১)। এর প্রধান কারণ ছিল ২০১০-২০১১ মৌসুমে বাংলাদেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে তার দূর্দান্ত সূচনা। ঐ সিরিজে আব্দুর রাজ্জাক ৩ খেলায় ১৩ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারও অর্জন করেন। এছাড়াও, সাম্প্রতিককালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তার ক্রীড়ানৈপূণ্যও এ কৃতিত্ব অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি সহযোগী খেলোয়াড় হিসেবে সাকিব আল হাসানের প্রয়োজনীয় উইকেট দখল করতে না পারাও এর উল্লেখযোগ্য কারণ।

একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে একটি হ্যাট্টিকও রয়েছে আব্দুর রাজ্জাকের। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩০৭৩ বিশ্ব ক্রিকেটের তম ওয়ানডে ম্যাচে এই সাফল্য অর্জন করেন রাজ্জাক। ২৮ মার্চ, ২০১৩ তারিখে প্রথম বাংলাদেশী বোলার হিসেবে দুইশত উইকেট সংগ্রহ করেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অনুষ্ঠিত তৃতীয় একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি পাঁচ উইকেট সংগ্রহ করার পথে এ গৌরব অর্জন করেন। ৫ মে, ২০১৩ তারিখে বুলাওয়ের কুইন্স স্পোর্টস ক্লাবে অণুষ্ঠিত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার নিজস্ব সেরা অপরাজিত ৫৩ রান করেন। এ রান করতে তিনি ৪টি চার ও ৫টি বিশাল ছক্কায় ২২ বল খেলেন যা ছিল দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ সংগ্রহ। তন্মধ্যে ২১ বল খেলে বাংলাদেশের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্রুততম অর্ধ-শতক করে রেকর্ড গড়েন। কিন্ত তার দল ৬ উইকেটে পরাজিত হয়।

আজ এই বাংলাদেশ ক্রিকেটের উজ্বল নক্ষত্র, স্পিন বোলিংয়ের অন্যতম হাতিয়ার, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঘূর্ণির জাদুকর আব্দুর রাজ্জাকের জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন প্রিয় খান আব্দুর রাজ্জাক রাজ।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »