শুভ জন্মদিন পাকিস্তান ক্রিকেটের বড় মিয়াঁ

কামরুল হাসান রাকিশ »

ক্রিকেটের ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ একটা দলের নাম পাকিস্তান। কখনো নিশ্চিত জেতা ম্যাচে হেরে যাওয়া, আবার কখনো প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে জয় ছিনিয়ে নেওয়া – দুটো কাজেই সিদ্ধহস্ত দলটি। ক্রিকেটে যুগে অনেক রথী-মহারথীর জন্ম দিয়েছে এই দেশটা; সেই বিখ্যাত মোহাম্মদ পরিবার থেকে শুরু করে হালের বাবর আজম।

কিংবদন্তি হানিফ মোহাম্মদ, বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইমরান খান, আকিব জাভেদ, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, পরবর্তীতে ইনজামাম-উল হক, শোয়েব আকতার, ইউনিস খান – এরা প্রত্যেকেই নিজেদের সময়ের সেরাদের কাতারে থাকবেন নিঃসন্দেহে। কেউ বল হাতে, কেউ ব্যাট হাতে। তবে ‘৭০-‘৮০ দশকে এদের সবার থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের এক ক্রিকেটার পেয়েছিল পাকিস্তান। অনেকের মতে তাকে পাকিস্তানের ইতিহাসেরই “সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার” বিবেচনা করা হয়। তিনি আর কেউ নন, তিনি পাকিস্তান ক্রিকেটের এক রথীমহারথীর নাম ‘বড়ে মিয়াঁ’-খ্যাত কিংবদন্তি “জাভেদ মিয়াদাঁদ”

ফিরে দেওয়া যাক আজ থেকে বেশকিছু বছর আগে, সালটা ১৯৫৭ সালের ১২ই জুন। বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ পাকিস্তানের করাচি শহরে জন্মগ্রহণ করে এক ফুটফুটে বালক। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তার প্রচণ্ড টান ছিল। বাবা করাচি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে কাজ করার সুবাদে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্রিকেটারদের দেখে দেখে হয়তো নিজের মনের অকপটে একজন সেরা খেলোয়াড় হওয়ার স্বাদ জেগেছিল।

সেই থেকে সূচনা। তার ইচ্ছাটা আরো জোরালো হয় বাবার হাত ধরেই। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে আসার পেছনে বাবার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। কেননা, বাল্যকালে পিতার থেকেই নিয়েছেন ক্রিকেটের অ-আ-ক-খ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে করাচির হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক। এরপরের গল্পটা কেবলই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার। প্রায় দুই যুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এরপর পাকিস্তান দলের কোচের দায়িত্ব ও পালন করেছেন।

তিনি পাকিস্তান ক্রিকেটের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি, নিশ্চসন্দেহে এটা সকল ক্রিকেটপ্রেমিরা মেনে নিবে। তিনি পাকিস্তান ক্রিকেটের ‘বড় মিয়াঁ’। তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। পাকিস্তান ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানও মনে করা হয় জাভেদ মিয়াঁদাদকে। তবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন লেগ স্পিনার হিসেবে। প্রায় দুই দশকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সবসময়ই প্রতিপক্ষের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে খেলেছেন। বাইশ গজে চুল পরিমাণ ছাড় দিতেন না এই পাকিস্তানি ব্যাটিং কিংবদন্তি। তাঁর লেখা আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেছেন।
সাদা পোশাকে অভিষেক হয় ১৯৭৬ সালে। ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই হাঁকিয়েছিলেন সেঞ্চুরি। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে লাহোরের গাদ্দাফী স্টেডিয়ামে প্রথম ইনিংসে ১৬৩ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে হার না মানা ২৫। পাকিস্তান ম্যাচ জিতে নেয় ৬ উইকেটের ব্যবধানে। ওই সিরিজের তৃতীয় টেস্টেই তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। করাচিতে সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে ২০৬ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেছিলেন ৮৫ রানের ইনিংস।


এরপরের গল্পগুলো আরও বেশী উজ্বলতা বয়ে আনে মিয়া সাহবের জীবনে। ক্রিকেটকে মিয়া সাহেব নিজের রাজ্য ক্ষমতায় আসীন করেন, ওনার রাজ্যে উনিই একমাত্র উত্তরাধিকারী।
ক্রিকেটের অভিজাত ফরম্যাটে ১৮৯ ইনিংসে ৫২. ৫৭ গড়ে করেছেন ৮,৮৩২ রান; যেখানে ২৩ শতকের বিপরীতে অর্ধশতক আছে ৪৩টি। টেস্টে সর্বোচ্চ ডাবল সেঞ্চুরি করা দশজনের একজন তিনি, আছে ছয়টি ডাবল সেঞ্চুরি। অবসর নেওয়ার সময় দেশের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরির মালিক ছিলেন ‘বড়ে মিয়াঁ’। পরবর্তীতে এই রেকর্ডটি ইউনিস খানের দখলে চলে যায়।
ভারতীয় ও অস্ট্রেলীয় দুই উপমহাদেশের সেরা দলগুলো নিয়ে একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছিল, যার নাম ছিল ‘অস্ট্রেলেশিয়া কাপ’। এই টুর্নামেন্টটি ছিল বিশ্বকাপের বাইরে প্রথম কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট। টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান। শারজায় সেই ফাইনালে টসে জিতে ভারতকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায় ইমরান খানের দল। প্রথমে ব্যাট করে গাভাস্কারের ৯০ আর শ্রীকান্তের ৭৫ রানের উপর ভর করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ভারতের সংগ্রহ ২৪৫ রান। তখনকার ক্রিকেটে এই টার্গেটটা মোটেও সহজ ছিল না।

লক্ষ্য তারা করতে নেমে শুরুতেই ব্যাকফুটে পাকিস্তান, ৬১ রানেই তারা হারায় তিন উইকেট। এরপর উইকেটে আসেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। এক প্রান্ত আগলে রেখে বলতে গেলে একাই জবাব দিতে থাকেন মিয়াঁদাদ। শেষ ওভারে পাকিস্তানের জিততে দরকার ১১ রান। তখনও উইকেটে পাকিস্তানের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল তিনিই।
ম্যাচ গড়ায় শেষ বল পর্যন্ত। শেষ বলে পাকিস্তানের দরকার চার রান, আর ভারতের দরকার এক উইকেট। স্ট্রাইকে মিয়াঁদাদ, বোলিং প্রান্তে চেতন শর্মা। উত্তেজনার পারদ-ঠাসা ম্যাচে নাটকের শেষ দৃশ্য তখনও বাকি। শারজার গ্যালারিতে তখন পিনপতন নীরবতা। শেষ মুহূর্তে উইকেটের চারদিকে ফিল্ডারদের অবস্থান শেষবারের মতো পরখ করে নিলেন। শেষ বল নিয়ে ছুটে আসছেন চেতন শর্মা। কোমর উচ্চতার ফুলটস ডেলিভারি। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে মিড উইকেটের উপর দিয়ে শারজার গ্যালারিতে আছড়ে ফেললেন মিয়াঁদাদ। কমেন্ট্রি বক্স থেকে ভেসে আসছিল, ‘This is six, and Pakistan have won. Unbelievable victory by Pakistan, and Javed Miandad, hero of the moment. This is unbelievable!”
১১৪ বলে ১১৬ রানের অতিমানবীয় ইনিংস খেলে ম্যাচের ম্যান অফ দ্য ফাইনাল সেই জাভেদ মিয়াঁদাদ। মিয়াঁদাদের শেষ বলে হাঁকানো সেই ঐতিহাসিক ছয় নিয়ে চেতন শর্মা পরে বলেছিলেন,
“এরপর যখনই কারো সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছে, সে আমাকে প্রথমেই প্রশ্ন করে আমার শেষ বলে মিয়াঁদাদের হাঁকানো সেই ঐতিহাসিক ছয় নিয়ে। এই জিনিসটা হতেই থাকে। এখন তো আমি নিজেই এটা উপভোগ করা শুরু করেছি!”
মাঠে নামলে একজন মিঁয়াদাদই সবকিছু উলটপালট করে দিতে পারতেন।
এই মিঁয়াদাদের সম্পর্কে একবার গ্রেগ চ্যাপেল বলেছিলেন- “If you want someone to bat for your life, Javed Miandad is the man to do it” দলে ইমরান খানের অনুপস্থিতিতে অধিনায়কত্ব করতেন তিনি। পাকিস্তান দলের সবচেয়ে কম বয়সে অধিনায়কত্ব করেছেন। তার অধীনে ৩৪ টেস্ট খেলে ১৪টিতেই জয় পায় পাকিস্তান।

ফিল্ডার হিসেবেও মাঠে যথেষ্ট কার্যকরী ছিলেন তিনি। ওয়ানডেতে ৭০ ক্যাচ আর টেস্টে ৯৩ ক্যাচই ফিল্ডার মিয়াঁদাদের সামর্থ্যের প্রমাণ দেয়। বোলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ম্যাচে পাঁচ উইকেট শিকারের কৃতিত্বও দেখিয়েছেন একবার। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান এই পাকিস্তানি ব্যাটিং কিংবদন্তি। জীবনের শেষ ইনিংসে ৩৮ রানে অপরাজিত ছিলেন।
খেলার পাশাপাশি ড্রেসিংরুমেও একজন অসাধারণ মানুষের অধিকারী ছিলেন জাভেদ মিঁয়াদাদ। কেউ কেউ তাকে গুরু হিসেবেও মান্য করতেন সেসময়। সবসময়ই সতীর্থদের জন্যও সেরাটা নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন মিয়াসাব। এ সম্পর্কে একবার টকশোতে পাকিস্তানি স্পিনার সাকলাইন মোস্তাক বলেছিলেন- ‘আমি ডিনারের টেবিলে সবসময় আতঙ্কে থাকতাম। কেননা, মাঠে কী ভুল করেছি না করেছি, এটা নিয়ে যেকোনো মুহূর্তে মিয়াঁদাদের দিক থেকে অভিযোগের তীর আসতে পারে আমার দিকে।’

ক্রিকেট, ক্রিকেটের বাহিরে সবসময়ই একজন “অসাধারণ” মানুষের পরিচয় দিয়ে এসেছেন তিনি। তিনিই পাকিস্তান ক্রিকেটের অন্যতম নক্ষত্র। পাকিস্তান ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা একজন।

শুভ জন্মদিন মিয়া সাহেব জাভেদ মিঁয়াদাদ।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »