কামরুল হাসান রাকিশ »
ক্যারিয়ারের প্রতিটি ধাপে রুবেল হোসেন নিজেকে উপস্থাপন করেছেন ভিন্নভাবে। কি নেই তাঁর ক্যারিয়ারে?
ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটকে লালন করেছেন বাবার কড়া শাসনের মধ্যে থেকেও। সব বাঁধা বিপত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রুবেল হয়েছেন দেশের ক্রিকেটের এক তারকা। আর এই তারকা ক্রিকেটার হওয়ার পেছনে তাঁর মায়ের অবদানই সবচেয়ে বেশি। মায়ের কোল থেকে বেরিয়ে এসে জীবনকে ক্রিকেটের কাছে বিলিয়ে দেওয়া এক দূরন্ত বালক আজকের এই রুবেল হোসেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে অনস্বীকার্য অবদানও কম ছিল না তাঁর।
অ্যাডিলেড মহাকাব্য থেকে শুরু করে কিউইদের বিপক্ষে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় সবকিছুতেই ছিল তাঁর অবদান। দ্রুতগতির এই পেস বোলার ধারাবাহিকভাবে গতি ও বাউন্সারে হয়েছেন ওস্তাদ।
বাংলাদেশে একজন গতির ঝড় তোলা এক্সপ্রেস বোলারের হাহাকার ছিলো। বাংলাদেশ তাই সেই সময়ে হন্য হয়ে খুঁজছিলো একজন সত্যিকারের পেস বোলার। এমন মহাসমারোহে আয়োজন করা হলো গ্রামীণফোন পেসার হান্ট। রুবেল তখন ঘরোয়া ক্রিকেটে তৃতীয় বিভাগ লিগে খেলছেন। শুনলেন এই প্রতিযোগিতার কথা, সাহস করে নামও দিলেন। এরপর আর থামায় কে! পেসার হান্টে হলেন প্রথম, চোখে পড়ে গেলেন কোচ সারোয়ার ইমরানের। তাঁর হাত ধরেই সুযোগ পেলেন জাতীয় দলের নেট বোলিং করার।
নিজের ক্যারিয়ারের শুরুতেই এমন ভরসার কারণে সারোয়ার ইমরানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন সুযোগ পেলেই। নেটে বোলিং করতে করতেই হঠাৎ করে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। না ছড়িয়ে উপায় আছে কী, বোলিং অ্যাকশনের সঙ্গে যে লাসিথ মালিঙ্গার বোলিং অ্যাকশনের অনেক মিল! মালিঙ্গা তখন রয়েছেন ফর্মের তুঙ্গে, তাঁর বল সামলাতে সবার রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। সেই মুহূর্তেই আগমন হয় বাংলার রুবেলের। নাম কাম তো ছড়াবেই! নেটে রুবেলের বোলিং দেখেই পত্রিকার শিরোনাম হলো, এসে গেছে বাংলাদেশের মালিঙ্গা!
অনূর্ধ্ব-১৯ দল হয়ে রুবেল দ্রুতই পৌঁছে গেলেন জাতীয় দলের দোরগোড়ায়। দরজাটা খুলেও গেল একদিন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যেদিন অভিষেক হলো রুবেলের, নেহাতই আনকোরা, ঘরোয়া ক্রিকেটেও ম্যাচ খেলেছেন হাতেগোনা কয়েকটা। তবুও সুযোগ পেলেন, কারণ তাঁর দুর্দমনীয় গতি। ২০০৯ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচেই জাত চেনান রুবেল, প্রথমে কিছুটা খরুচে হলেও পরে একে একে চারটি উইকেট তুলে নিয়ে গুটিয়ে দিলেন শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং লাইন আপের লেজটুকু। এরপর সেই সিরিজের একটা ম্যাচে বেধড়ক মার ও খেলেন মুরালিধরনের ব্যাটে। তবুও দমে যাননি। এরপর ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরে ভয়ংকর এক ইয়র্কারে মিলসের উইকেট উপড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে জয়ের স্বাদ এনে দেন রুবেল হোসেন।
২০১১ সালে হঠাৎ জিম্বাবুয়ে সফরের পর থেকে যেন সব এলোমেলো হতে শুরু করলো, হুট করেই যেন হারিয়ে গেল রুবেল হোসেন। মূলত ইনজুরির কবলে পড়েই হারিয়ে গেল তাঁর ‘এক্স ফ্যাক্টর’ গতির ঝড়টাও।
২৯ অক্টোবর, ২০১৩, মিরপুরের শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বনাম নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার খেলায় তৃতীয় বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন বাগেরহাটের এই পেসার।
একে-একে নিউজিল্যান্ডের কোরি অ্যান্ডারসন, ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম এবং জিমি নিশামকে আউট করে এ বিরল কীর্তিগাঁথা রচনা করেন রুবেল হোসেন।
৯ মার্চ, ২০১৫। অ্যাডিলেড ওভালে মুখোমুখি বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ড। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম ও সৌম্য সরকারের ব্যাটিং নৈপুণ্যে বাংলাদেশ দলগতভাবে সম্মানজনক পুঁজি দাঁড় করায়। পরবর্তীতে তাঁর প্রশংসনীয় বোলিংয়ে (৪/৫৩) বাংলাদেশ ১৫ রানের ব্যবধানে ইংলিশদের হারিয়ে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
অথচ এই বিশ্বকাপের স্কোয়ার্ডে থাকা নিয়েও সংশয় ছিলো রুবেল হোসেনের। সব বাঁধা পেরিয়ে সবার আস্থার প্রতিদানও দিয়েছিলেন রুবেল। বর্ণাঢ্য তাঁর এই ক্যারিয়ারে অনেক সময় বিভিন্ন অভিজ্ঞতার স্বীকার হয়েছেন।
বিভিন্ন সময় নানা বিতর্কেও জড়িয়েছিলেন। তবে কোনোকিছুই তাঁর গতিকে ধমিয়ে রাখতে পারেনি। তীব্র গতিতে একের পর এক বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানকে ঘায়েল করেছন রুবেল। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা শেষ উইকেটটা আজও লাখ কোটি ক্রিকেট প্রেমীদের মনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়।