দুর্জয় দাশ গুপ্ত »
যারা দেশের ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখেন, যারা দেশের ক্রিকেটাকে মনে ধারণ করেন তাদের কাছে সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামি নামটা বেশ পরিচিত। জনপ্রিয় ক্রিকেট এক্সপার্ট, স্পোর্টস প্রেজেন্টার হিসেবে তার রয়েছে বেশ খ্যাতি। এর বাইরেও তিনি একজন পেশাদার ক্রিকেটার, নিয়মিত খেলছেন দেশের প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সামি স্বাক্ষী হয়েছেন এক ইতিহাসের। বাংলাদেশ ও ভারতীয় নারী দলের মধ্যকার দ্বিপাক্ষীয় সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে আন্তর্জাতিক কমেন্টেটর হিসেবে অভিষেক হয়েছে সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামির। কমেন্ট্রিতে নিজের অভিষেকেই সামি করেছেন বাজিমাত। পিচ রিপোর্ট থেকে শুরু করে পোস্ট ম্যাচ প্রেজেন্টেশন পর্যন্ত মাইক্রোফোন হাতে সামি ছিলেন অনবদ্য, করেছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব।
আন্তর্জাতিক কমেন্টটের হিসেবে যাত্রা শুরু করা সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামির সাথে একান্ত আলাপকালে নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কমের রিপোর্টার দুর্জয় দাশ গুপ্ত জেনেছেন অনেক অজানা গল্প। সেসব গল্পই নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কমের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হয়েছে।
প্রশ্নঃ আপনি এখন অফিসিয়ালি একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কমেন্টেটর, এই ব্যাপারটা কিভাবে দেখছেন?
সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামিঃ অবশ্যই এটা একটা পজিটিভ সাইন। বাংলাদেশে কমেন্ট্রি আগে ওতটা জনপ্রিয় ছিলো না বা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও কমেন্ট্রি নিয়ে ও ভাবে চিন্তা করেনি। কিন্তু এখন যেহেতু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এগিয়ে এসেছে এবং খেলার সংখ্যাও বাড়ছে, সামনে আরো বাড়বে। একইসাথে বাংলাদেশের হয়ে কমেন্ট্রি করা বলতে বাংলাদেশকেও রিপ্রেজেন্ট করা বিশ্ববাসীর কাছে এই যেমন আমি যখন ম্যাচের পরে পোস্ট ম্যাচ প্রেজেন্টেশনটা করেছি সেটা তো ভারতের মানুষও দেখেছে সেক্ষেত্রে এটা অবশ্যই ভালো লাগার ব্যাপার এবং আমার জন্যও একটা বড় পাওয়া। দিনশেষে আমি নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি। আমি এই ব্যাপারটা পজিটিভলিই নিচ্ছি।
প্রশ্নঃ যখন পিচ রিপোর্ট করতে গেলেন আপনার অনুভূতিটা কেমন ছিল?
সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামিঃ আসলে আমি আগেরদিনও জানতাম না আমি পিচ রিপোর্ট করবো। আমাকে বলা হয়েছিলো আমি টস রিপোর্টটা করবো। কিন্তু ম্যাচ ডে’তে মিরপুরে পৌঁছার পর জানতে পারলাম আমি পিচ রিপোর্ট করবো। ব্রডকাস্টিং থেকে বলা হলো আমি যেহেতু একজন ক্রিকেটার তাই পিচের ব্যাপারটা আমি ভালো বুঝবো, আমাকে পিচ রিপোর্ট করতে হবে। তখন আমি মিরপুরের পিচ কিউরেটর গামিনী ডি সিলভার সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম এটা তৃতীয় টি-টোয়েন্টি’র উইকেট। গামিনীর সাথে কথা বলার পর আমি যখন পিচটা দেখলাম তখন বুঝতে পারলাম পিচের আচরণটা কেমন হবে। আর এই পিচটায় কিছু ঘাস ছিলো। আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি পিচটা কেমন হবে। আমি যখন ঢাকা লীগে খেলি তখন অনেকসময়ই আমার দলের অধিনায়ক পিচের কন্ডিশন এবং আচরণ কেমন হবে সেটার পরামর্শ আমার থেকে নেন। আমি পিচ দেখেই বুঝতে পারি উইকেটের আচরণ কেমন হবে। তাই আমার জন্য খুব একটা সমস্যা হয়নি। তবে আমি যখন পিচ রিপোর্ট করার জন্য মাঠে ঢুকলাম, ম্যানুয়াল স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়ে একটা স্মৃতিচারণ হলো। ২০১০ সালে আমি প্রথম মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে প্রথম ঢুকি। তখন এনসিএল টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট চলছিলো। পাকিস্তানের শোয়েব আকতার একটা দলের হয়ে খেলছিলেন। আমি তাকে দেখার জন্যই মাঠে আসি তখন আমার পকেটে ছিলো মাত্র ২০ টাকা। ৮ টাকা বাস ভাড়া দিয়ে আমার পকেটে ছিলো কেবল ১২ টাকা। এই টাকা দিয়ে তো আর টিকেট কেনা যায় না। তখন হুট করেই জড়ো হতে থাকা মানুষের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। কোন কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই আমিও লাঠিচার্জের শিকার হই। তবুও আমি কোন রকমে তখনকার স্কোরবোর্ডের পাশের গেট দিয়ে ঢুকে দূর থেকে শোয়েব আকতারকে দেখছিলাম। সেদিনের সেই লাঠিচার্জ খেয়ে মিরপুর স্টেডিয়ামে প্রথম ঢুকার মুহূর্তটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মনে হলো জীবনটা আসলে এমনই। একদিন এখানে ঢুকতে মার খেয়েছি আর আজ আমি আন্তর্জাতিক ম্যাচের পিচ রিপোর্ট করতে যাচ্ছি।

মেহেদী হাসান মিরাজের সাথে সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামি
প্রশ্নঃ কমেন্টেটর হিসেবে জার্নির শুরুটা কিভাবে হলো? এবং ঠিক কতটা বছর সময় লেগেছে নিজেকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে?
সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামিঃ জার্নিটা অনেক লম্বা। আমি ইউনিভার্সিটি লাইফে প্রথম কমেন্ট্রি শুরু করি। ২০১২ সালে আমি তখন ভার্সিটির ছাত্র। আমাদের আন্তঃ ইউনিভার্সিটি টুর্নামেন্ট চলছিলো। ইউল্যাবের মাঠে আমি শেষের দুই বলে দুইটা ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেয়েছিলাম। ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিতে গিয়ে কথা বলেছিলাম আর তখনই প্রথমবারের মত আমার বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল ইসলাম স্যারের সাথে দেখা হয়। স্যার আমাকে বললেন, ‘তোমরা এই জেনারেশনের স্মার্ট ছেলে হয়ে কমেন্ট্রি করছো না কেন? এখন তো রেডিওতে কমেন্ট্রি শুরু হয়েছে।’ আমি অবাক হয়ে স্যারকে বললাম, ‘কমেন্ট্রি তো কোনদিন করিনি আর কোথায় করবো সেটারও তো সুযোগ নেই।’ তখনকার সময় কেবল বেসরকারি রেডিও স্টেশন পিপলস রেডিওতে খেলার কমেন্ট্রি চলতো। রকিবুল হাসান স্যার পিপলস রেডিওতে আমার কমেন্ট্রি করার সুযোগ করে দিলেন। তখন তো আমি একদম নতুন, কমেন্ট্রি কিভাবে করতে হয় জানতাম না। পিপলস রেডিও থেকেই আমার হাতেখড়ি হয় এবং একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করা শুরু করি। এরপর দেখা গেলো দেশের আরো কয়েকটা রেডিও স্টেশনও কমেন্ট্রি শুরু করলো, আমাদের সুযোগও বাড়লো। এভাবেই আমার কমেন্ট্রি ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিলো। এখন পর্যন্ত অলমোস্ট ১১ বছরের একটা জার্নি।
প্রশ্নঃ কমেন্ট্রিতে আপনার কি কোন আইডল আছে? থাকলে সেটা কে এবং তার কোন ব্যাপারগুলো আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?
সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামিঃ দেখেন সেভাবে আসলে কমেন্টেটর হিসেবে আমার কোন আইডল নেই। যারা নন এশিয়ান তাদের ক্ষেত্রে কমেন্ট্রি করাটা অনেক সহজ। কারণ ইংরেজি ভাষাটা অনেকের ক্ষেত্রেই মাতৃভাষা। কিন্তু এশিয়ান কমেন্টেটর যারা আছেন তাদের জন্য এই ব্যাপারটা বেশ কঠিন। নিজের দেশের ভাষার বাইরে গিয়ে অন্য একটা ভাষায় আপনাকে ম্যাচের কমেন্ট্রি করতে হয়। সেক্ষেত্রে এশিয়ান কমেন্টেটরদেরই আমার ভালো লাগে। তাদের মধ্যে রবি শাস্ত্রী, হার্শা ভোগলে, দিনেশ কার্তিক উনাদের কমেন্ট্রি আমি সুযোগ পেলেই শুনি এবং উপভোগও করি। আর বিশেষ করে বলতে হয় আমাদের দেশের শামীম আশরাফ চৌধুরীর কথা। একজন ৭৫+ বয়সের মানুষ হয়েও নিয়মিত কমেন্ট্রি করাটা চাট্টিখানি কথা না। দেখেন আমরা অনেকেই অনেক কিছু বলতে পারি, সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু যারা এই পজিশনে কাজ করছেন, এই বয়সে এসেও দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন এটা অবশ্যই বড় একটা ব্যাপার। আমাদের উচিত তাদেরকে সম্মান জানানো।

শাহরিয়ার নাফীস ও সামি
প্রশ্নঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে এই পেশাটা কেমন? এবং ক্রিকেটার না হয়েও কি কমেন্টেটর হওয়া সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তাহলে সেটা কতটা কষ্টকর হতে পারে?
সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামিঃ ইন্টারন্যাশনাল কমেন্ট্রি অবশ্যই দারুণ কিছু। আমাদের দেশে যদিও কমেন্ট্রি করা বা কমেন্টেটর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চলটা খুব একটা নেই। এখন বিসিবি এগিয়ে এসেছে, সামনে আরো ভালো কিছু হবে আশা করছি। কমেন্ট্রির জন্য যে আপনি আমাদের দেশে ভালো কোন প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেবেন এমন সুযোগ কিন্তু এখানে নেই। যা’ই করবেন আপনাকে নিজে থেকে করতে হবে। এই যেমন সাদমান সামিত মির্জার কথাই ধরুণ, আমার সাথে তারও আন্তর্জাতিক কমেন্টেটর হিসেবে অভিষেক হয়েছে। সে পুরনো ম্যাচের ভিডিও প্লে করে ঘরে বসে কমেন্ট্রি করতো। তারপর ফেসবুক গ্রুপগুলোতে পোস্ট করেই আলোচনায় আসে। আমি যখন প্রথম তার কমেন্ট্রি শুনি তখন কোন কিছু না ভেবেই এলএমএসের (লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ড) দুজনকে ট্যাগ করে তার ভিডিওটা শেয়ার করি। পরে জানতে পারি সাদমান এলএমএসে কমেন্ট্রি করার সুযোগ পায়। এই যেমন একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়েছে বলেই সাদমান কমেন্ট্রি কন্টিনিউ করতে পেরেছে।
আরেকটা ব্যাপার যেটা বললেন ক্রিকেটার না হয়েও কমেন্টেটর হওয়া যায় কিনা তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে আমাদের দেশের সমন্বয় ঘোষ। সেও কিন্তু রেডিওতে কমেন্ট্রি শুরু করেছিলো। আমি ক্রিকেটার হলেও সমন্বয় কিন্তু ক্রিকেটার না। সে তার নিজের প্রচেষ্টা আর পরিশ্রমের কল্যাণেই আজ আন্তর্জাতিক কমেন্টেটর হতে পেরেছে। তাই আমি বলবো কেন নয়? অবশ্যই সম্ভব। তবে আপনাকে আপনার স্বপ্নের দিকে অনড় থাকতে হবে, আপনাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে এবং নিজেকে সেভাবে তৈরি করতে হবে। এখন দেখুন বাংলাদেশের খেলা হলে বা বড় কোন টু্র্নামেন্ট হলে প্রায় বেশিরভাগ রেডিও স্টেশনই কমেন্ট্রি করে। এটার মাধ্যমে এখন ব্যবসাও করা যায়। কমেন্ট্রি দিয়ে যে ব্যবসা করা যায় সেটা গর্বের সাথেই বলতে চাই বাংলাদেশের রেডিও স্টেশনগুলোতে আমিই শিখিয়েছি। ছক্কা মারলে বা উইকেট পড়লে সেটার আগে আপনি স্পন্সরের নাম বলতে পারবেন। এই ব্যাপারটা কিন্তু আগে ছিলো না।
প্রশ্নঃ কমেন্টেটর হিসেবে নিজেকে ৫ বছর পর কোথায় দেখতে চান?
সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামিঃ আসলে এটা এখন বলা মুশকিল। তবে আমার নিজের একটা স্বপ্ন আছে যেটা এখন আমি বলবো না। হয়তো আমি সেই স্বপ্নের জন্যই প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। আমি প্রতিদিন শেখ জামাল মাঠে সকালে ২০০-২৫০ জন ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করি। আমি যতটুকু জানি বা জানতে সক্ষম হয়েছি আমি সেটা দিয়েই চেষ্টা করি আমার মাধ্যমে কোন ক্রিকেটার যদি উপকৃত হয়। তবে অবশ্যই একটা কথা বলবো আমি গেম ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করতে চাই। হয়তো যদি সামনে আরো ভালো সুযোগ আসে আমার কাছে তাহলে আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবো। আমি আসলে এমন একটা মানুষ যে পরাজয় জিনিসটা মেনে নিতে পারি না। আমি সবসময় চেষ্টা করি আমার স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে পরিণত করার। তবুও ৫ বছর অনেক লম্বা সময় সময়ই সেটা বলে দিবে। হয়তো আপনারাই আমাকে এরচেয়েও ব্যাটার কিছুতে দেখবেন।
প্রশ্নঃ অনেকদিন ধরেই আপনাকে একটা প্রশ্ন করার জন্য মুখিয়ে আছি। আমরা আপনাকে একেক সময় একেক ভূমিকায় দেখি, কখনো ক্রিকেটার, কখনো প্রেজেন্টার আবার এখন কমেন্টেটর হিসেবেও দেখছি, সবকিছু কিভাবে সামাল দেন? এর পেছনে কি আপনার কোন জাদু আছে?
সৈয়দ আবিদ হোসাইন সামিঃ দেখেন ২৪ ঘন্টা আমার জন্য অনেক বেশি সময়। আপনি যদি অযথা বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের দোষ, ভুল এসব নিয়ে সমালোচনা না করে নিজের কাজ করেন তাহলে দেখবেন ২৪ ঘন্টা অনেক লম্বা সময়। আমি চেষ্টা করি সবসময়ই আমি যতটা সেক্টরে জড়িত আছি সবগুলোতে নিজের সেরাটা দেবার। এবং আপনিও যদি চেষ্টা করেন দেখবেন ২৪ ঘন্টায় আপনি অনেক কিছু করতে পারবেন। আমি ট্রাফিক জ্যামে বসে আমার আরেকটা প্রজেক্ট “অন ফিল্ড” এর জন্য কনটেন্টের স্ক্রিপ্ট রেডি করি। ট্রাফিক জ্যামে বসে যদি আমি কাজ করতে পারি তাহলে ২৪ ঘন্টা সময় কেন কম হবে? অবশ্যই যদি আপনি সৎ থাকেন, আপনার উদ্দেশ্য সঠিক থাকে আপনি এই ২৪ ঘন্টায়ই অনেক কিছু করতে পারবেন। এটার জন্য কোন জাদু বা অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় না। সবশেষে আমি নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কমের পাঠকদেরকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানাচ্ছি। আমার জন্য আপনারা দোয়া করবেন।