গাজী নাসিফুল হাসান »
বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেট পাগল বা ক্রিকেট প্রেমী যাই বলি না কেন এটি বাঙ্গালীর অনেক বড় একটি আবেগ। আর এই আবেগকে ধরে রেখে কেউ কেউ এই ক্রিকেট নিয়ে অনেক বড় কিছু করেন। যার মধ্যে এক বড় নাম হচ্ছে মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। যাকে সবাই চিনে দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন নামে। তার সংগ্রহে নেই হয়তো এমন জিনিস কম আছে। ক্রিকেটে সম্ভাব্য সকল কিছু তিনি তার সংগ্রহে রেখে দিয়েছেন। তার মতো এরকম ক্রিকেট পাগল মানুষ যিনি কিনা ক্রিকেটকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। আজ আমরা এই দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তার সংগ্রহ নিয়ে আমরা আপনাদের জানাবো। আর এতে আপনি জানবেন কেন তিনি দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত হলেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দিনকে দিন এগিয়ে যাচ্ছে অবাধ গতিতে। আর তার সাথে তাল মিলিয়ে জসিমের স্মারক সংগ্রহের ভান্ডার দিনকে দিন ভারী হচ্ছেই। কি নেই দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক জসিমের স্মারক সংগ্রহে? হয়তো প্রথম দেখায় আপনি তার স্মারক সংগ্রহশালা দেখলে অবাক হয়ে যাবেন কিন্তু অবাহ হবেন না জসিম। আর তার এই স্মারক সংগ্রহ তিনি যেভাবে তার নিজের কাছে আগলে রেখেছেন মনেই হবে না যে এটি কোনো স্মারক এটি তার সন্তানের মতো। ক্রিকেটারদের ব্যাট, বল, গ্লাভস, জার্সি , স্ট্যাম্প কি নেই জসিমের স্মারক সংগ্রাহশালায়। আর তার কাছে এমন নয় যে তিনি শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের স্মারক সংগ্রহ করেন তার কাছে পুরো ক্রিকেট বিশ্বের খেলোয়াড়দের স্মারক তার কাছে রয়েছে। জসিম বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি যিনি কিনা এই স্মারক সংগ্রহ করেছেন এবং অতি যত্নে তা তার সংগ্রহশালায় রেখেছেন।
তার সম্পর্কে আরো কিছু বলার আগে তার পুরো পরিচয় জানাটা আগে দরকার। তার পুরো নাম হচ্ছে মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। তার জন্ম হয়েছে বরিশাল জেলার অন্তর্গত বাকেরগঞ্জ উপজেলার নন্দীপাড়া নামক এক গ্রামে। এই গ্রামেই ছোট থেকে বড় হয়েছে জসিম উদ্দিন। জসিম উদ্দিন তার গ্রামেই নন্দপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করা শুরু করেছিলেন। স্কুল জীবন থেকেই জসিমের ক্রিকেটের প্রতি বেশ মনোযোগ ছিলো। তবে একটি দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, জসিমের ছোটবেলায় তার মাকে হারিয়েছেন আর এতে ছোটবেলা থেকেই মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মাত্র আট মাস বয়সে মাকে হারান জসিম। আর ছোটবেলায় দাদীর কাছে বড় হতে থাকেন জসিম। তার পরিবার ছিলো অস্বচ্ছল। যার জন্য সে তার লেখাপড়া বেশিদূর এগোতে পারেনি। আর এই অস্বচ্ছলতার কারণে এস.এস.সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়ে আর পড়াশোনায় নিয়মিত হতে পারেননি জসিম।
তবে জীবনটা হাল ছাড়বার নয়, আর হাল ছাড়েননি জসিম। স্বপ্ন ছিলো তার ক্রিকেটার হবার। অনেক পথ পেরিয়ে জসিম ঘরোয়া এক ক্লাবে জায়গা করে নেন। সাধারণ বিমা নামে একটা দলের হয়ে খেলার খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে ক্রিকেটার হিসেবে বেশিদূর যেতে পারেননি। তবে ক্রিকেটের প্রতি নেশা তার ভিতর ঝুঁকে বসে। আর তার মাথায় নেশা ধরে ক্রিকেটার হতে পারিনি তো কি হয়েছে আমি এমন কিছু করবো যা ক্রিকেটের এক স্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন। আর এই থেকে তিনি শুরু করেন ক্রিকেটের স্মারক সংগ্রহ করা।
সময়টা ছিলো ১৯৯৮। মূলত এই সাল থেকেই জসিম শুরু করেন তার ক্রিকেট স্মারক সংগ্রহ করা। তিনি সেবছর ঢাকা আসেন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত মিনি বিশ্বকাপ দেখতে। জসিম মাত্র ২০ টাকা নিয়ে লঞ্চে করে ঢাকায় আসেন জসিম শুধুমাত্র ক্রিকেটকে ভালোবেসে। লঞ্চে করে ঢাকায় আসা জসিম নিজেকে তৈরি করেছেন ক্রিকেট সংগ্রহের সাগর হিসেবে। জসিম সেসময় পাকিস্তান ক্রিকেটের এক বড় ভক্ত ছিলো তবে অবশ্যই নিজের দেশের আগে নয়। ১৯৯৮ সালে যে মিনি বিশ্বকাপ দেখতে জসিম ঢাকা এসেছিলেন সেসময় তিনি জানতেন না যে, বাংলাদেশ এই আসরে খেলছে না। আর এটি তার আফসোস ছিলো।
১৯৯৮ সালের ২৯শে অক্টোবর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলতে নেমেছিলো পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গুলিস্তান থেকে ৫টাকা দিয়ে প্ল্যাকার্ড কিনে মাঠে গিয়েছিলেন। ওয়াসিম আকরামের ছবি ছিলো সেই প্ল্যাকার্ডে। আর জসিম বসে ছিলেন ঠিক পাকিস্তানের ড্রেসিং রুমের পাশে। ওয়াসিম আকরাম বোলিং শেষে যখন তিনি ড্রেসিং রুমে ফিরছিলেন ঠিক সেসময় প্ল্যাকার্ড উচিয়ে ধরেন জসিম। সেসময় মইন খান ওয়াসিম আকরামকে বলেছিলেন যে, ঐ দেখো ওয়াসিম তোমার ছবি হাতে। ওয়াসিম আকরাম সেই প্ল্যাকার্ডে অটোগ্রাফ দেন। এখান থেকেই শুরু হয় জসিমের স্মারক সংগ্রহ। এরপর আম্পায়ারদের সহায়তা নিয়ে পাকিস্তান দলের কাছে যান। ওয়াসিম আকরাম তাকে খুশি হয়ে হোটেলের লবিতে আসতে বলেন। এখান থেকেই আরো বড় করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন জসিম। এরপর বড় আশা নিয়ে যান হোটেলে। রিসিপশনের গিয়ে ওয়াসিম আকরামের সাথে দেখা করার বিষয়ে বললে রিসিপশনিষ্ট পাকিস্তান দলের লিয়াজো কর্মকর্তার কাছে জসিমের কথা বললে পাকিস্তান দলের লিয়াজো কর্মকর্তা এসে তাকে অপেক্ষা করতে বলেন। আর এই অপেক্ষা করতে গিয়ে তার পরিচিত হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেকের সাথে। এরপর আবারো দেখা হয়ে যায় ওয়াসিম আকরামের সাথে। সেসময় জসিম ওয়াসিম আকরামের কাছে তার পরিহিত একটি জার্সি চান। ওয়াসিম আকরাম জসিমকে হতাশ করেননি বরং জসিমকে তার অটোগ্রাফ দিয়ে জার্সি দেন। এই স্মারক সংগ্রহের কাজে সহায়তা করেন তৎকালীন আম্পায়ার ডেভিড শেফার্ড ও আইসিসির সিকিউরিটি অফিসার।
এরপর ২০০০ সালে বাংলাদেশ দল খেলতে নেমেছিলো তাদের প্রথম টেস্ট ক্রিকেট ভারতের বিপক্ষে। তবে জসিম সব কিছু বাদ দিয়ে নজরৈ রেখেছেন স্টাম্প, জার্সি আর অটোগ্রাফের দিকে। আর তিনি সেটি আদায় করেছেন। আর সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের জার্সি, স্ট্যাম্প, দুই দলের ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ করা ব্যাট এখনো জীবন্ত।
২০০৫ সালে বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ের সিরিজ ছিলো। সেই ম্যাচটিতে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন নাদিম ঘৌরি এবং আইসিসির সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন কর্ণেল নূর। জসিমের আগে থেকেই এদের সাথে সখ্যতা ছিলো। আর এই সখ্যতা থেকে নাদিম ঘৌরিকে জসিম বলেছিলেন, “আমাকে একটি স্ট্যাম্প এনে দিবেন।” নাদিম ঘৌরি বলেছিলেন, “আম্পায়াররা এটা করতে পারবে না।” এরপর অনেক আকুতি মিনতি করেন জসিম। এরপর নাদিম ঘৌরি বলেন, ” যদি কোনো খেলোয়াড় না নেয় তবে তোমার জন্য একটা আনবো।” আর খেলা শেষে নাদিম ঘৌরি জসিমের জন্য স্ট্যাম্প নিয়ে আসেন। জসিম সেই স্ট্যাম্প দেখে আবেগী হয়ে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে।
মজার আরেকটি বিষয় হচ্ছে ওয়াসিম আকরাম এরপর থেকে যতবারই বাংলাদেশে এসেছেন ততবারই জসিমের সাথে দেখা করেছেন এবং কিছু না কিছু জসিমকে দিয়ে গিয়েছেন।
ধীরে ধীরে জসিমের সাথে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের সাথে সখ্যতা তৈরি হতে থাকে। তার সাথে পরিচয় হয় খালেদ মাহমুদ সুজন ও ফাহিম মুনতাসির সুমিতের সাথে। এরপর থেকে আরো পরিচয় হয় আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, খালেদ মাহমুদ সুজন, মোহাম্মদ রফিক, নাইমুর রহমান দুর্জয়, শান্ত, হাবিবুল বাশার হ মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, শাহরিয়ার নাফিস, মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, নাফিস ইকবাল, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমসহ সাবেক বর্তমানসহ সকল ক্রিকেটারদের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। ক্রিকেট পাড়ায় স্মারক সংগ্রাহক হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন মোহাম্মদ জসিম। আর সেই থেকে জাতীয় দলের সব ক্রিকেটার তো বটেই আর তা দেশ থেকে ভিন দেশী ক্রিকেটারদের সাথেও জসিমের সখ্যতা জমে উঠেছিলো।
আরো একটি মজার কথা শোনাই আপনাদের। ১৯৯৮ সাল থেকে দেশের মাটিতে যত আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সকল ম্যাচের টিকেট রয়েছে জসিমের সংগ্রহে। তার কাছে আছে শাহাদাত হোসেনের ওয়ানডে ও অলক কাপালির হ্যাট্রিক করা বল। আরো আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যত অধিনায়ক এসেছে সব অধিনায়কের অটোগ্রাফসহ ব্যাট। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান মেহেরাব হোসেন অপির দেয়া অটোগ্রাফ করা ব্যাট। বাংলাদেশ দলের প্রথম টেস্টের সব খেলোয়াড়দের অটোগ্রাফসহ একটি টি-শার্ট, প্রথম টেস্টের একটি স্ট্যাম্প, বাংলাদেশের হয়ে যারা বিশ্বকাপ খেলেছেন সকল খেলোয়াড়দের অটোগ্রাফ রয়েছে তার কাছে। ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত এশিয়া একাদশ বনাম বিশ্ব একাদশের সবার অটোগ্রাফসহ একটি ব্যাট রয়েছে তার কাছে। বলতে গেলে অনেক কিছুই রয়েছে তার কাছে। তার কাছে এত এত সংগ্রহ রয়েছে যে, এটি দিয়ে অনায়াসে ক্রিকেটের জাদুঘর তৈরি করা যাবে।
সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে প্রায় ১০০০ অটোগ্রাফ সম্বলিত ব্যাটহ বল আছে ৫০০ এর মতো। আর এর সবই প্রায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ম্যাচের। ঘরোয়া ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মিলিয়ে তার কাছে রয়েছে প্রায় ৫০০০ এর মতো জার্সি। ১৯৯৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তার কাছে রয়েছে দেশি-বিদেশি ক্রিকেট সংক্রান্ত ম্যাগাজিন আছে প্রায় ২০০০। এছাড়াও আছে দেশি ও বিদেশি মিলিয়ে প্রায় ১০০ ক্রিকেটারের গ্লাভস যার মধ্যে রয়েছে শচীন টেন্ডুলকার, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ক্রিস গেইল, মহেন্দ্র সিং ধোনি, স্টিভেন স্মিথ, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, অলক কাপালি তাদের মধ্যে অন্যতম। ক্যাপ আছে প্রায় ৫০০। যা ব্যবহার করা হয়েছিলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে। এসব সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস, আর এই ইতিহাসের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। তার কাছে রয়েছে শেষ ওয়ার্ন, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ওয়াসিম আকরাম, রিকি পন্টিং, ম্যাথিউ হেইডেন, সৌরভ গাঙ্গুলি, স্টিভ টিকোলো, অ্যালিস্টার কুক , কেভিন পিটারসেন, ড্যানিয়েল ভেটরিসহ অসংখ্য ক্রিকেটার। এছাড়াও বাদ যায় নি এশিয়া একাদশ বনাম বিশ্ব একাদশের মধ্যকার হওয়া ম্যাচ দুটিও। এশিয়া একাদশ বনাম বিশ্ব একাদশের মধ্যকার ম্যাচে যারা খেলতে নেমেছিলো তাদের সবার কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে জসিমকে দিয়েছেন অলক কাপালি। এমনকি জসিমকে এশিয়া একাদশ বনাম বিশ্ব একাদশের ম্যাচটি শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হয় আর শ্রীলঙ্কা যাবার বিমান ভাড়াও দিয়েছেন অলক কাপালি। আর ভারতেও গিয়েছিলেন অলক কাপালি ও এনামুল হক জুনিয়রের প্রচেষ্টায়।
জসিমকে নিজের ভাইয়ের মতো জানতেন প্রয়াত মাঞ্জারুল ইসলাম রানা। বগুড়া থেকে আসার পথে জসিমকে এসি গাড়িতে করে পাশে বসিয়ে নিয়ে এসেছিলেন প্রয়াত রানা। সেসময় হঠাৎ করে বমি করে দিয়েছিলেন জসিম রানার গায়ের উপর লেগেছিলো। রানা ভাই রাগ করেননি একটুও বরং মজা করেছিলেন। রানা মারা যাবার আগের রাতে ইম্পেরিয়াল হোটেলে তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছিলেন। এছাড়া মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন অনেক বড় ভক্ত মুশফিকুর রহিমের। তাকে যদি মুশফিকুর রহিম রাত চারটার দিকেও ডাক দেয় তবে তিনি ছুটে যাবেন। জসিম যে কত বড় ক্রিকেট প্রেমী তার পাগলামী দেখলেই বোঝা যায়।
শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কার মধ্যকার যে টেষ্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সেই টেষ্টের অটোগ্রাফ দেয়া টিকেট এবং জার্সি অটোগ্রাফ দেয়া যেটি বাংলাদেশের শততম টেস্ট ম্যাচ জয়। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডকে টেস্ট হারানো ম্যাচের টিকেট এবং দুই দলের অটোগ্রাফ দেয়া ব্যাট ও জার্সি। জসিমের এমনও হয়েছে যে ব্যাটে দলের সকলের অটোগ্রাফ নেবার পর কেউ বাকি থাকলে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটার্স সাপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সাথে দুই বার এবং টেলি কোম্পানি রবির সাথে একবার জার্সি উৎসবে যুক্ত হয়ে তার সংগ্রহ প্রদর্শিত হয়। হোটেল রেডিসন ব্লুতে ইউনিলিভারের সাথে একত্রিত হয়ে তার স্মারক প্রদর্শিত হয়।
১৯৯৮ সাল থেকে এখন অবধি বাংলাদেশ দলের যত জার্সি রয়েছে তার সব রয়েছে জসিমের সংরক্ষণে। আর এই ১৯৯৮ পাল থেকে সকল টিকেট তার সংগ্রহে রয়েছে। এত টিকেট তার কাছে রয়েছে যে তার গুণে শেষ করা যাবে না। শুধু বাংলাদেশ নয় বরং বিদেশের ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ সম্বলিত জার্সি রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম লোগো সম্বলিত জার্সিও রয়েছে জসিমের সংরক্ষণে।
একটি বিষয় কি এতক্ষণে লক্ষ্য করেছেন? যে ক্রিকেট বোর্ড ব্যতীত একজন ব্যক্তি একা এত স্মারক সংগ্রহ করেছেন। তবে ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তারা তাকে সহযোগিতা ও সমর্থন না দিলে এতদূর আসতে পারতেন না।
২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশের এমন কোনো খেলা নেই যেটা জসিম বাদ দেন নি। সম্ভাব্য সকল খেলা তিনি দেখেছেন। যেগুলো দেশের বাহিরে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলো টিভিতে বসে এবং যেগুলো ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলো মাঠে বসেই দেখেছেন। এমনকি সেটি বাংলাদেশৈর যেকোনো ভেণ্যুতেই হোক না কেন। শুধু যে আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখেছেন তা কিন্তু নয় বরং ঘরোয়া ক্রিকেট ও দেখেছেন। আর্থিক কারণে বিদেশ গিয়ে খেলা দেখতে না পারলেও তিনি বাংলাদেশ দলকে সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন। খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে বাংলাদেশ দলকে সমর্থন দেয়াই ছিলো তার কাজ। তবে নিজের খরচে এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় খেলা দেখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটার অলক কাপালি জসিমের সকল খরচ বহন করে তাকে পাকিস্তান নিয়ে গিয়েছিলেন।
এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন যে জসিমের সংগ্রহশালা কতটা বিশাল। আর এই বিশাল সংগ্রহশালা রক্ষণাবেক্ষণ করাও অনেক কষ্টসাধ্য একটি কাজ। কারণ এগুলো তো ফেলনা জিনিস নয় কারণ এমন একটা সময় আসবে যে আমরা হয়তো বেঁচে থাকবো না কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট থাকবে আর বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমর্থকরা তো এই জসিমের সংরক্ষণ থেকেই জানবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস। জসিম বিয়ে করেন ২০১২ সালে। প্রথম দিকে তার স্ত্রী এসব দেখে বিরক্ত হলেও ধীরে ধীরে তিনি এসবের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকেন। এখন জসিমের এই বিশাল সংগ্রহশালার সংরক্ষণের পুরো কাজ করেন তার সহধর্মিণী। আর এত সংগ্রহ তো ঢাকায় রাখা যাবে না ভাড়া বাসায়। বরং তিনি কিছু জিনিস তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জে রেখে আসেন। আর সেখানেই জসিমের সাথে ঘটে যায় এক দুর্ঘটনা। কিছু জার্সি চুরি হয়ে যায়। এক বস্তা জার্সি ইঁদুর খেয়ে ফেলে যেখানে ছিলো ওয়াসিম আকরাম, অ্যালিস্টার কুকের মতো খেলোয়াড়ের জার্সি। এমনি চুরি হয়েছে বল, ব্যাট ও স্ট্যাম্প।
তার এই ব্যাট, বল, জার্সি সংগ্রহ করতে কতটা কষ্ট হয়েছে তার তিনি হারে হারে টের পেয়েছেন। একটা অটোগ্রাফের জন্য তার ৪-৫ বছর পর্যন্ত সময় লেগে গিয়েছিল। ২০০৭ সালেও দিকে বিসিবির এক কর্মকর্তা জসিমকে বকা দিয়েছিলেন বলেছিলেন যে, তুমি খেলোয়াড়দের বিরক্ত করো, তুমি অটোগ্রাফ বিক্রি করো। তোমাকে যেন আর না দেখি। এরপর কি হয়েছিলো? ভাবছেন জসিম থেমে গিয়েছে? না না মোটেও না জসিমের সাময়িক একটু কষ্ট হয়েছিলো তবে তিনি তো জানতেন যে তিনি কি করেন। তিনি খেলোয়াড়দের ভালোবেসে এগুলো সংগ্রহ করেন। আর তার এইসব কাজে বিসিবির অনেক কর্মকর্তা তাকে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করেছেন।
এসব সংগ্রহ তিনি কখনো বাণিজ্যিক কারণে প্রদর্শন করেননি। আর তাছাড়া বিসিবির নীতি পরিপন্থী কিছু করতে নারাজ জসিম। তবে বিসিবি যদি জসিমকে সহায়তা করে তবে জসিম চান একটি ক্রিকেট মিউজিয়াম গড়ে তুলবেন। সেখানে তিনি তার সংগৃহীত স্মারক উৎসর্গ করবেন দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে।
খেলোয়াড়দের সাথে জসিমের ছবিও আছে প্রায় ৩০০০। ওয়াসিম আকরাম, সৌরভ গাঙ্গুলিসহ অনেকের সাথে ছবি তুলেছেন এবং সেই সাথে ছবিতে অটোগ্রাফ দিয়েছেন। বিদেশি আম্পায়ারদের সাথেও জসিমের রয়েছে ভালো সম্পর্ক। এমনকি আম্পায়ারদের নিয়েও অনেক সংগ্রহ রয়েছে। নাদিম ঘৌরি, নাদির শাহ আর স্টিভ বাকনারের সঙ্গে রয়েছে অনেক স্মৃতি। তবে এত সংগ্রহের পরও জসিমের একটি আফসোস রয়েছে তার হলো যে, তার ইচ্ছা ছিলো ব্রায়ান লারা কিছু তার সংগ্রহে রাখা। কিন্তু তিনি সেটা করতে পারেনি। জসিমের আরো একটি বিষয় খারাপ লাগে তাই হলো যে, বাংলাদেশ দল যখন খারাপ খেলে তখন অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খারাপ মন্তব্য করে যা তাকে অনেক কষ্ট দেয়। তিনি সকল সমর্থকদের সবসময় অনুরোধ করেন যেন ভালো ও খারাপ সবসময় দলকে সমর্থন দেয়।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে এসেছিলেন তিনি বিশ্বকাপ দেখতে আর ওয়াসিম আকরাম দিলেন প্ল্যাকার্ডে স্বাক্ষর আর তার থেকেই বাসা বাঁধে এই স্মারক সংগ্রহের। যেহেতু ক্রিকেটার হতে পারেননি ভেবেছিলেন ছিল স্মারক সংগ্রহ করবেন। কে ভেবেছিলেন সেদিনের এই জসিম হয়ে উঠবেন দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক। তার এখন একটি স্বপ্ন যা হচ্ছে ” ক্রিকেট জাদুঘর “।
পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক যখন ছিলেন মিসবাহ উল হক। তখন একবার রাত ১২টার সময় ফোন করে দেখা করার অনুরোধ করেছিলেন জসিম। পরে মিসবাহ উল হক জসিমের সাথে ডিনার করেন। পরে মিসবাহ উল হক জসিমকে বলেছিলেন যে, “শুধু তুমি বলেছো বলেই আমি এসেছি অন্য কেউ বললে আমি আসতাম না।”
জসিম বলেছিলেন এটাই তার বড় প্রাপ্তি।
দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন তার সর্বশেষ যে স্মারকগুলো সংগ্রহ করেছেন তার হচ্ছে: বাংলাদেশ বনাম ভারতের মধ্যকার প্রথম দিবা রাত্রির টেষ্টের পিঙ্ক বল, সেই ম্যাচের বাংলাদেশ ও ভারতের সকল ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ দেয়া ব্যাট ও জার্সি। এছাড়া বিপিএল এর সর্বশেষ আসরের চ্যাম্পিয়ন দল রাজশাহী রয়্যালসের সকল খেলোয়াড়দের অটোগ্রাফ দেয়া ব্যাট, বল ও জার্সি। এছাড়া অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি যে শেষ ম্যাচ খেলেছেন সে ম্যাচের সকল খেলোয়াড়দের অটোগ্রাফ দেয়া ব্যাট। মাশরাফির অটোগ্রাফ দেয়া বল ও টিকেট।
এতবছর ধরে প্রায় ২২ বছর হলো দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক মোহাম্মদ জসিম স্মারক সংগ্রহ করছে এই স্মারক সংগ্রহ করে জসিমের কি কোনো প্রাপ্তি রয়েছে কি? হ্যাঁ রয়েছে। তাকে অনেক ক্রীড়া সংগঠন এবং ক্রিকেট ফ্যান গ্রুপগুলো তাকে সম্মাননা দিয়েছে। তবে তার জীবনে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার হাত থেকে দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহকের সম্মাননা পাওয়া তার জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি বলে মনে করেন তিনি। তা তো হবেই মাশরাফির হাত থেকে দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহকের পুরষ্কার চাট্টিখানি কথা নয়।
দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক মোহাম্মদ জসিমের এই সংগ্রহ নিয়ে বলতে গেলে তা শেষ করা যাবে না। কেননা তার এত এত স্মারক সংগ্রহে রয়েছে তা যদি বলতে থাকি তবে শেষ হবেই না বরং তা চলতেই থাকবে তো চলতেই থাকবে। আর তার এই স্মারক সংগ্রহ যে পর্যায়ে গিয়েছে তার ছিল এই লেখায় শেষ করা যাবে না কেননা তার যেমন অনেক স্মারক রয়েছে তেমনি তার রয়েছে এই স্মারক সংগ্রহ নিয়ে মজার মজার গল্প। তাই বলাই বাহুল্য যে এই দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক জসিমকে নিয়ে একটি বই লিখা যেতেই পারে। জসিমের স্মারক সংগ্রহ দিনকে দিন যে পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে তা তার ভাড়া বাসায় রাখা সম্ভব হয় না। তবে অন্যান্য বিষয়গুলো ছাপিয়ে যে বিষয সবচেয়ে বড় নজর কেড়েছে তা হলো জসিম দেশসেরা ক্রিকেট স্মারক সংগ্রাহক হবার পরও তিনি সাদামাটা জীবনযাপন করছেন তার মধ্যে নেই কোনো অতিরিক্ত বিলাসিতা। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন জসিম এই স্মারক সংগ্রহ করা শুরু করেছেন তখন কেউ এই স্মারক সংগ্রহ করতো না। কিন্তু বর্তমানে জসিমের দেখাদেখি অনেকেই এই কাজ করে থাকে। তবে জসিম এই ধারণার প্রবর্তক। আমাদের সকলের চাওয়া জসিম যেন তার এই স্মারক সংগ্রহের নেশাটা ধরে রাখতে পারে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এই ক্রিকেটের ইতিহাস তুলে ধরতে পারে। আর তার যে স্বপ্ন রয়েছে ক্রিকেটের জাদুঘর তৈরি করা তা যেন পূরণ। জসিম এগিয়ে যাক দূর্বার গতিতে সেই সাথে এগিয়ে চলুক বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাফল্যগাঁথা, আর ভারি হোক জসিমের সংগ্রহশালা।