চৌধুরী মোহাম্মদ ইমতিয়াজ »
বাংলাদেশ ক্রিকেটে জাহানারা, সালামাদের উত্তরসূরী খুঁজা বেশ দুষ্কর। ক’দিন আগেও যা দূর আকাশের তারা হয়ে ছিল, তা এখন ধরা দিতে শুরু করেছে হাতের মুঠোয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসছেন প্রতিভাবান তরুণীরা। স্বপ্ন বুনছেন লাল-সবুজের জার্সিতে শের-ই বাংলায় বাঘিনীদের দলে যোগ দিতে। সে পথে এগোতে ব্যাট-প্যাড নিয়ে নেমে পড়ছেন ইনডোর কিংবা আউটারের নেটে।
তেমনই এক তরুণী চট্টগ্রামের ক্ষুদে নারী ক্রিকেটার সৃজা কবির নিধি। বেড়ে উঠছেন চট্টগ্রাম ক্রিকেট একাডেমীর পরিচর্যায়। দু’চোখে স্বপ্ন সেরাদের কাতারে নাম লেখানোর, দেশের জন্য বয়ে আনবেন সম্মান। নিউজক্রিকেট২৪ কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে উঠে এসেছে উদীয়মান এই নারী চায়নাম্যান অলরাউন্ডারের গল্প।
ছোটবেলা থেকেই পেশা হিসেবে ক্রিকেটে মনোনিবেশ। তবে সামাজিক কিংবা পারিবারিক নানান সমস্যার কারনে আসা হয়নি ব্যাট-বলের সান্নিধ্যে। পরবর্তীতে বাবার হাত ধরে ৫ জানুয়ারি, ২০১৯ সালে শুরু হয় সৃজার স্বপ্নকে সত্যিতে রূপ দেওয়ার যুদ্ধ। বাঁহাতি চায়নাম্যান, ব্যাট হাতে চার নম্বরেই স্বাচ্ছন্দ্য। বিশেষত ভারতীয় চায়নাম্যান বোলার কুলদীপ যাদবের মতো হতে চান এই নারী ক্রিকেটার। ব্যাটিংয়ে অবশ্য নিজ দেশের সাকিব আল হাসান।
জানা গেছে নারীদের ক্রিকেটে ব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে থাকার ব্যাপারটিও। চট্টগ্রামে নারীদের জন্য নেই বলার মতো ম্যাচ খেলার সুযোগ। তুলনামূলক কম পরিমাণে ম্যাচ হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন সৃজা। তবে তিনি স্থানীয় লীগ পর্যায়ে বেশকিছু ম্যাচ খেলেন বলে জানান। এছাড়াও আরো বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়েছে সৃজা কবির নিধির সঙ্গে। তার চুম্বকাংশ তোলে ধরা হলো পাঠকের জন্য।
নিউজক্রিকেট: কোন একাডেমীতে এবং কখন ক্রিকেট শুরু করেছিলেন?
সৃজা: চট্টগ্রাম ক্রিকেট একাডেমিতে শুরু করেছিলাম ২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি।
নিউজক্রিকেট: বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নারীরা ক্রিকেটে আসা বেশ শোচনীয়। সেক্ষেত্রে আপনার ক্রিকেট পেশায় আসার গল্পটা কেমন?
সৃজা: ক্রিকেট পেশায় আসার ইচ্ছা ছিলো অনেক আগে থেকেই, যখন আমি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। ছোট থেকেই বাবার সাথে বসে সব রকমের ক্রিকেট ম্যাচ দেখা হতো। ঠিক কিভাবে ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে নিয়েছি তা মনে নেই। তবে ছোট থেকেই যে সবার ইচ্ছা থাকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে, আমার ইচ্ছা ছিলো শুধু ক্রিকেটার হব। আমার কখনো কোনো সেকেন্ড চয়েস ছিলো না। শুধু একটাই মাথায় ঘুরতো যে ক্রিকেটার হব। তখন মুশফিকের ফ্যান ছিলাম। বাবাকে অনেক বলতাম আমি ক্রিকেট খেলবো তবে বাবা তা সিরিয়াসলি নিতো না। প্রথম কারণ হচ্ছে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা কেউ দেখেনা ওতো মুল্য নেই (তার ধারনা ছিলো তখন)। দ্বিতীয়ত যেহেতু ছোট থেকেই শহরে থাকা আর বাবা চাকুরীজীবি, বাসা থেকে একাডেমি অনেকটাই দূরে। আসা যাওয়ার সমস্যার কারনে বাবা আর এগুতে চাননি ক্রিকেটে। পরে অনেক অনুরোধে আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে ২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারী একাডেমীতে ভর্তি করান বাবা, ৫ জানুয়ারি থেকে ক্রিকেটে আমার পথচলা শুরু।
নিউজক্রিকেট: কোন পজিশনে বেড়ে উঠছেন? ব্যাটিং/বোলি? ডান/বাঁহাতি?
সৃজা: শুরু থেকেই আমি মূলত একজন অলরাউন্ডার হয়ে খেলে আসছি। চার নম্বরে ব্যাটিং করার পাশাপাশি বাঁহাতি চায়নাম্যান। ব্যাটিংও বাঁহাতি।
নিউজক্রিকেট: এখন পর্যন্ত কতদূর এগিয়েছেন? ডোমেস্টিক পর্যায়ে সুযোগ পেয়েছেন কি?
সৃজা: কিছু লিগ খেলেছি। তবে এখন পর্যন্ত ভালোভাবে খেলার সুযোগ হয়ে উঠেনি, কারণ চট্টগ্রামে মেয়েদের ম্যাচ অনেক কম পরিমাণে হয়ে থাকে। ডোমেস্টিক পর্যায়ে এখনো সুযোগ হয়নি।
নিউজক্রিকেট: পড়ালেখার পাশাপাশি পেশাদার ক্রিকেট খেলা, ক্রিকেট কিংবা পড়ালেখায় কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে কি?
সৃজা: না। কারন দুটোকেই সমান ভাবে বজায় রেখে চলতাম। তবে মাঝে মাঝে লেখাপড়া কে একটু কম সময় দেওয়া হতো। যেহেতু আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সেহেতু দেখা যায় অনেক বেশী সময় দিতে হয় পড়ালেখাকে। যা হয়তো মাঝে মাঝে আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। তবে চেষ্টা করি ক্রিকেট আর লেখাপড়া দুটোকেই ঠিকভাবে বজায় রেখে এগোতে। কারণ ক্রিকেট এর পাশাপাশি লেখাপড়াটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নিউজক্রিকেট: আমরা সবাই জানি যে, বর্তমান করোনাভাইরাসের কারনে দীর্ঘদিন ক্রিকেটীয় কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ। বন্দী সময়টা কেমন কাটছে?
সৃজা: বন্দী সময়টা পুরোপুরি ফ্যামিলির সাথেই কাটছে। মাঝে মাঝে নিজেই রান্না করি, অনেক রান্নাও শিখেছি এই সময়ে। আমি নাচও করতাম, এখন সুযোগ পেয়ে এটার রিহার্সালও হচ্ছে। সাথে ব্যাটিং ড্রিল করি, ফিটনেস নিয়ে কাজ করি। এছাড়া মুভি দেখা, ফেসবুকিং এসব করেই সময়টা পার হচ্ছে।
নিউজক্রিকেট: লম্বা এই বিরতির পর মাঠে ফিরে ব্যাট-বলের সাথে মানিয়ে নেওয়াটা কেমন হবে?
সৃজা: হ্যাঁ এতদিন ক্রিকেট এর সবরকম কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তাই শুরু হলে আরো বেশী সময় দেওয়ার চেষ্টা করবো ক্রিকেটকে।
নিউজক্রিকেট: লম্বা এই বিরতির পর মাঠে ফিরে ব্যাট-বলের সাথে মানিয়ে নেওয়াটা কেমন হবে?
সৃজা: এই বিরতি টা আমাদের জন্য আসলে অনেক বেশী ক্ষতিকর।কারণ ভালো ক্রিকেটার হতে হলে প্রাক্টিসের কোনো বিকল্প নেই। আর এতো লম্বা সময় ক্রিকেট প্রাক্টিস থেকে দূরে থাকাতে দেখা যাচ্ছে আমরা আগেও যা শিখেছি তার থেকেও অনেকটা পিছিয়ে যাচ্ছি। তো এ সময়গুলো ঠিকভাবে পেলে হয়তো ক্রিকেটের অনেক কাজ করতে পারতাম এবং ভালো কিছু হতো। তাই বিরতিটা আমাদের জন্য অনেক বেশী ক্ষতিকর বলে মনে হচ্ছে।
নিউজক্রিকেট: ভালো ক্রিকেটার হতে হলে, ভালো ফিটনেসের বিকল্প নেই। ফিটনেস নিয়ে কেমন কাজ করা হয় আপনার?
সৃজা: আসলে ক্রিকেট এর ৮০ শতাংশই ফিটনেস এর উপর নির্ভর করে বলে আমি মনে করি। ফিটনেস ছাড়া কোনভাবেই ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিং কোনোটায় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়।ফিটনেস নিয়ে সবসময় কাজ করার চেষ্টা করি। একাডেমিতে গ্রুপ ফিটনেস এর পর আমি বাসায়ও আলাদা কাজ করে থাকি। কারন যত বেশী ফিটনেস হবে ঠিক ততবেশী ভালো ক্রিকেট খেলা যাবে।
নিউজক্রিকেট: আইডল হিসেবে কাকে অনুসরণ করেন?
সৃজা: আইডল হিসেবে কুলদীপ যাদব (ভারত) কে অনুসরণ করি। তার বোলিং অনেক বেশী ভালো লাগে আর তার মতো করারও চেষ্টা করি। তবে ব্যাটিংয়ে সাকিব আল হাসান।
নিউজক্রিকেট: বাংলাদেশের কোন নারী ক্রিকেটারের মতো চান?
সৃজা: কাউকে তেমন অনুসরণ করিনা। তবে জাহানারা আপু এবং সুমনা আপুকে অনেক বেশী ভালো লাগে।
নিউজক্রিকেট: ক্রিকেট পেশায় স্বপ্নটা কেমন? ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
সৃজা: প্রথমত আমার স্বপ্ন এখন বিকেএসপি তে চান্স পাওয়া। এরপর ওখান ভালো কিছু করে জাতীয় দলে সুযোগ করে নেওয়া। বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের একজন দক্ষ খেলোয়াড় হয়ে বাংলাদেশকে অনেক জয় উপহার দিতে চাই। যারা এখনো নারী ক্রিকেটকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেনা তারাও যেন উৎসাহ নিয়ে ক্রিকেট দেখে এবং সাপোর্ট করে। ঠিক জানিনা কতদূর যেতে পারব, তবে আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছি জাতীয় দল পর্যন্ত পৌঁছানোর এবং তাতে আমি আত্মবিশ্বাসী।