একজন আশিকের করোনা জয়ের গল্প

দুর্জয় দাশ গুপ্ত »

সাবেক ক্রিকেটার ও বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের কোচ আশিকুর রহমান করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেয়েছেন কিছুদিন আগে। সুস্থ হয়ে বাসাবোর নিজ বাড়িতে এখন অবস্থান করছেন তিনি। নিজের ১১তম বিবাহবার্ষিকী আজ। বিবাহবার্ষিকীর দিন বিকেলে মুঠোফোনে নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কমকে করোনা জয়ের গল্প শুনিয়েছেন আশিকুর রহমান।

দুর্বিষহ সেই যুদ্ধের পুরো গল্প পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

নিউজক্রিকেটঃ কেমন আছেন এখন? শরীর ঠিকঠাক?

আশিকুর রহমানঃ আগের থেকে এখন অনেক ভালো আছি। পুরোপুরি ঠিক হতে সময় লাগবে আরো কিছুটা। শরীর এখনো অনেকটা দুর্বল। বাইরে গেলে একটু কাজ করলে শরীরটা খারাপ লাগে।

নিউজক্রিকেটঃ মরণঘাতি করোনাভাইরাস জয় করলেন। অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?

আশিকুর রহমানঃ করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এ “ভয়” শব্দটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি যদি এখন কাউকে বলি আপনি ভয় পেয়েন না তখন সেটার কোন ভিত্তি থাকবে না। কারণ এটা এমন একটা রোগ এখানে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ভয় পান কোন সমস্যা নেই তবে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে শক্তি দিয়ে পাঠিয়েছে সে শক্তি দিয়ে আমি লড়ে যাবো। এভাবে চিন্তা করতে হবে। মনে সাহস রাখতে হবে। শুরু থেকে মাথায় যদি করোনার সাথে লড়ে যাওয়ার মনোবল তৈরি হয় তবে সেটা অনেক সাহায্য করবে। একটা সময় আমি নিজেও ভেবেছি আমি আর ফিরবো না বাসায়, আমি মারা যেতে পারি। কারণ শুরু থেকেই আমরা দেখেছি অনেক মানুষ মারা গিয়েছেন কাজেই ভয়টা চলে আসে। আর এই রোগের সাথে আমরা পরিচিত না। শুরুর দিকে এই ব্যাপারগুলো আমাকে আক্রমণ করেছে। আমার যে ডাক্তার ছিলেন উনার পরামর্শ মত আমি দুটো করে প্যারাসিটামল খেয়েছি। জ্বরটা যখন কমতো তখন আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতাম আবার যখন জ্বর আসতো তখন খারাপ লাগা কাজ করতো। আশেপাশের মানুষের সমর্থনের মতই গুরুত্বপূর্ণ নিজের আত্মবিশ্বাসটা। আমি বুদ্বদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দের বাণী পড়েছি। এগুলো আমাকে প্রেরণা দিয়েছে।

নিউজক্রিকেটঃ কোভিড-১৯ পজিটিভ আসার পরে কি করলেনঃ

আশিকুর রহমানঃ সাবের স্যার (সাবের হোসেন চৌধুরী) এবং বিসিবির ডাক্তার দেবাশীষ চৌধুরীর সাথে আমি কথা বলি। উনারা আমার টেস্টের ব্যবস্থা করে দেন। পরে আমার রেজাল্ট পজিটিভ আসলে উনারা আমাকে মুগদা হাসাপাতলে ভর্তি হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এবং আমার ওয়ার্ডের শামীম ভাই শুরু থেকেই আমাকে সাহায্য করেছেন।

নিউজক্রিকেটঃ কি কি লক্ষণ ছিলো?

আশিকুর রহমানঃ আমি বৃষ্টিতে ভিজে একদিন কাজ করেছিলাম। পরে যখন বাসায় আসলাম আমার জ্বর এসেছে, তারপর গলা ব্যথা করছিলো। আমি ভেবেছি ঠান্ডা লেগেছে এবং টনসিলের সমস্যা হয়তো। তখন জ্বর আসে যায় কিন্তু একেবারে কমে না। গলা ব্যথাও বাড়তে থাকে। তখন আমি সবার সাথে কথা বলি, বিসিবিতে জানাই। জ্বর, গলা ব্যথা ছিলো এরপর সাতদিনের মাথা কাশি আসে। এরপর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। কাশতে কাশতে একটা সময় মনে হতো বুকে ১০০ কেজি ওজনের কোন পাথর কেউ রেখে দিয়েছে। খুব কষ্ট হতো।

নিউজক্রিকেটঃ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা কেমন ছিলো?

আশিকুর রহমানঃ আসলে করোনার শুরু থেকেই অনেকে হাসপাতাল নিয়ে অনেক কিছু বলছেন। হাসপাতালে যদি আমরা স্বাভাবিক সময়ের মত সেবা পাওয়ার কথা চিন্তা করি তবে সেটা হবে ভুল। করোনা একটি ভয়ানক ভাইরাস, এটা বৈশ্বিক মহামারী, প্রাণের ভয় ডাক্তারদেরও আছে। আমি বলবো সুযোগ থাকলে অবশ্যই হাসপাতালে যাওয়া উচিত। আমি যেখানটায় ছিলাম সেখানে ২৫০ জন রোগীর জন্য ১৭ জন ডাক্তারের একটা করোনা টিম ছিলো। ১৭ জনের মধ্যে সেখানে ১১ জন ডাক্তারই আক্রান্ত হয়ে গিয়েছেন। বাকি ছিলেন মাত্র ৬ জন। এরপর অন্য হাসপাতাল থেকে ডাক্তার নিয়ে আসা হয়েছে। ডাক্তাররা অবশ্যই আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তবে আরেকটা ব্যাপার হলো হাসপাতালে ডাক্তারদের থেকেও নার্স, ক্লিনারদের সেবা ছিলো খুবই জরুরী। ডাক্তাররা আসে কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু নার্স, ওয়ার্ড বয়রা সবসময় থাকে। ২৪ ঘন্টা সার্ভিস দেয়। আমি মনে করি এরাই প্রকৃত ফ্রন্টলাইনার। একদম সামনে থেকে এরা প্রেরণা দিয়ে যায়। আমি মনে করে একজন রোগী তাদের জন্যই সাহস পায় এবং ৫০ ভাগ সুস্থ হয়ে যায়। সময় মত ওষুধ দেওয়া থেকে শুরু করে যা যা প্রয়োজন সবই তারা করে। আমার ওয়ার্ডে একটা ছেলে ছিলো যে আমাকে সবসময় সাহস দিতো। আমাকে এরকমও বলেছে, ‘ভাই তিন মাস ধরে এখানে আছি। বাসায় যাই না। পাশের রুম থেকে অনেক সময় কান্নার শব্দ আসতো মৃত্যুর ভয়ে। তবুও আমরা কাজ করেছি। আপনি হাল ছাড়বেন না।’ আমি যে পরিস্থিতিতে ছিলাম তখন এই ছেলেটাকে আমার মনে হয়েছে সবচেয়ে বড় ডাক্তার। মনে হয়েছে সৃষ্টিকর্তার কোন বার্তা প্রেরক। করোনা ভাইরাস এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তখন বাঁচার জন্য সব কিছু করতেই রাজি হয় মানুষ। প্রতিদিন কত মানুষ মারা যায়, কত ওয়ার্ড বয়, ক্লিনার আক্রান্ত হচ্ছে তবুও তারা কাজ করে যাচ্ছে। প্রকৃত যোদ্ধা এরাই। হাসপাতালে গেলে সেবা করোনাকালে অনেক ভালো পাওয়া যায়। আর যদি আমরা স্বাভাবিক সময়ের মত সেবা আশা করি তবে সেটা হবে ভুল।

নিউজক্রিকেটঃ বিসিবি থেকে সহায়তা কেমন পেয়েছেন?

আশিকুর রহমানঃ আমি বিসিবিকে অনেক ধন্যবাদ দিবো। বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন সুজন ভাই, খালেদ মাহমুদ সুজন ভাই, নাইমুর রহমান দুর্জয় ভাই তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বিসিবি আমার পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে সে সময়টাতে। আমার বাসার ঈদের বাজারটা পর্যন্ত করে দিয়েছে। এবং ঐ সময়টাতে মানসিক যে সমর্থন পেয়েছি বিসিবি থেকে আমি এর জন্য কৃতজ্ঞ থাকবো। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি কয়েকবার কিন্তু যখনই দুর্জয় ভাই, সুজন ভাই, কাওসার ভাইয়ের ফোন পেয়েছি তখনই আবারো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। এছাড়া কোয়াবের সাধারণ সম্পাদক দেবু ভাই (দেবব্রত পাল) আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। এবং একইসাথে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই বোর্ড সভাপতিকে। এই ভয়াবহ সময়টাতে তাদেরকে পাশে পেয়েছি।

নিউজক্রিকেটঃ করোনা আক্রান্তদের প্রতি আপনার কোন বার্তা।

আশিকুর রহমানঃ নিজেদের উপরে আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। এবং আরেকটা ব্যাপার হলো কেউ যেন ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে না দেয়। আপনার কি জ্বর আছে? শ্বাসকষ্ট আছে? এগুলো যেন কেউ না বলে। কারণ এমনিতেই আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক অবস্থা খুব খারাপ থাকে। সবাই যেন উৎসাহ দেন। সবাই সাথে যেন থাকে। আর ধ্যান করতে হবে। আমি প্রচুর ধ্যান করেছি সেই সময়টাতে। অনুপ্রেরণামূলক বাণী পড়েছি। এগুলো খুব কাজে দিয়েছে।

নিউজক্রিকেটঃ করোনা মুক্ত হওয়ার অনুভূতিটা কেমন ছিলো?

আশিকুর রহমানঃ দ্বিতীয়বার যখন মোবাইলে আমার ম্যাসেজ আসলো নেগেটিভ তখন সবার আগে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। সেদিনও শুক্রবার ছিলো আজকের মত। আজ সকালেও সেদিনটার কথা মনে হয়েছে। সেই মুহূর্তটায় আমার শরীর থেকে কি একটা যেন বের হয়ে গেছে। আমরা যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকি তবে সেটার প্রভাব আমাদের চেহারার উপরে পড়ে। তবে রিপোর্ট আসার সাথে সাথে সেই প্রভাবটা চলে গিয়েছে। আমি তখন আমার বাবা-মা’কে ফোন করেছি। আমি সাবের ভাই সহ দুর্জয় ভাই, সুজন ভাই সবাইকে ফোন করেছি। মনে হয়েছে আমি নতুন একটা জীবন পেয়েছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানিয়েছি। খারাপ সময়টাতে যাদেরকে পাশে পেয়েছি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি করোনাভাইরাসের ওষুধটা যেন দ্রুত বের হয়। মৃত্যুর মিছিলটা যেন কমে যায় এটাই কামনা। আমি বাসায় ফিরেও ১৪ দিন সবার থেকে আলাদা ছিলাম। আমার ছেলে-মেয়ে ছোট, ওরা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। ওরা আমাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। আমার কাছে আসতে পারে নি। করোনাভাইরাস আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।

নিউজক্রিকেটঃ পরিকল্পনা কি এখন?

আশিকুর রহমানঃ আমরা মাঠের মানুষ, মাঠে ফিরতে চাই। আর করোনাভাইরাস আমার জন্য একটা বড় শিক্ষা। সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে আমি বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে স্নায়ুর যে চাপ সেটা নিয়ে বাচ্চাদের সাথে কাজ করতে চাই। কারণ আমি মনে করি আমি বুঝতে পেরেছি চাপটাকে কিভাবে সামাল দিতে হয়।

নিউজক্রিকেটঃ নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কম আপনার সুস্থতা কামনা করে এবং শুভকামনা ভবিষ্যতের জন্য।

আশিকুর রহমানঃ আপনাকেও ধন্যবাদ এবং নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কমের সকল পাঠকদের জন্য শুভেচ্ছা।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »