আমাদের সময়ে সঠিকভাবে পরিচর্যা করার লোকের অভাব ছিলোঃ ফাহিম মুনতাসির

দুর্জয় দাশ গুপ্ত »

১৯৮০ সালের ১ নভেম্বর ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার ফাহিম মুনতাসির রহমান। ক্রিকেটে হাতেখড়ি ঘটে ১৯৯০ সালে দশ বছর বয়সে। ময়মনসিংহের স্থানীয় একটি ক্লাবে খেলা শুরু করা ফাহিম একটা সময় বাংলাদেশ জাতীয় দলে জায়গা করে নেন নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে। যদিওবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি। বাংলাদেশের জার্সিতে ৩ টেস্ট আর ৩ ওয়ানডে খেলা ফাহিম নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানলেও এখনো জড়িয়ে আছেন ক্রিকেটের সাথে। নিজের একাডেমীতে উদীয়মান ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সবশেষ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ বিপিএলে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

কোয়ারেন্টাইনের অবসর সময়টাতে মুঠোফোনে ফাহিম মুনতাসির রহমানের সাথে হলো অনেক আলোচনা। নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পাশাপাশি কথা বলেছেন দেশের ক্রিকেটের বিভিন্ন দিক নিয়েও।

পাঠকদের জন্য পুরো সাক্ষাৎকার হুবহু তুলো ধরা হলো।

নিউজক্রিকেটঃ আপনারা মাঠের মানুষ। ক্রিকেট নিয়েই সবসময় কাজ করতে হয়। লম্বা সময় ধরে ক্রিকেট বন্ধ। সময়টা কিভাবে কাটছে?

ফাহিম মুনতাসিরঃ আসলে এই সময়টাতে ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কেবল বিশেষ প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হয় তবে সেটা কিছু সময়ের জন্য। বাচ্চাদের সাথেই সময় কাটাচ্ছি। এই আরকি।

নিউজক্রিকেটঃ আপনার ক্রিকেটে আসার গল্পটা জানতে চাইবো।

ফাহিম মুনতাসিরঃ আমি ক্রিকেট শুরু করি ১৯৮৯-৯০ এর দিকে। ময়মনসিংহে প্রথম প্র্যাকটিস শুরু করি। কাউন্ট্রি ক্রিকেট ক্লাবের মাধ্যমেই শুরু হয়। কাজী মোহাম্মদ হাসান স্যারের হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয়। স্যার আমাদের অনেককিছু দিয়েছেন। সেই সময় থেকে উঠে আসা বেশিরভাগ ক্রিকেটারই ছিলো ময়মনসিংহের। প্রায় ৮০ ভাগ ক্রিকেটার উনার মাধ্যমেই উঠে আসে। তবে আমরা স্যারকে খুব বেশি কিছু দিতে পারিনি। এটা একটা আফসোস থেকে যাবে।

নিউজক্রিকেটঃ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনি এবং মাশরাফি বিন মর্তুজার এক দিনে অভিষেক হয়। মাশরাফি বাংলাদেশ দলের কান্ডারী হয়ে উঠেছেন। এখনো সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আপনার ক্যারিয়ারটা খুব বেশি লম্বা হয়নি। এর কারণ কি আসলে?

ফাহিম মুনতাসিরঃ এটা ঠিক যে মাশরাফি আর আমার একসাথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিলো তবে মাশরাফি আমার অনেক জুনিয়র। আর আমার কম খেলার কারণ হলো মূলত আমি একজন ব্যাটসম্যান ছিলাম। হয়তোবা দলের প্রয়োজনে বল করেছি। আর তখন আসলে বুঝতামও কম। সঠিকভাবে পরিচর্যা করার মত লোকের অভাব ছিলো। আর আমি ব্যাটিংয়ের জন্য যতটুকু কাজ করেছি, শ্রম দিয়েছি সে তুলনায় বোলিংয়ের জন্য খুব বেশি কিছু করিনি। এটাও একটা কারণ। কিন্তু পরে যখন একজন বোলার হিসেবে সুযোগ পেয়েছি তখন কষ্ট করেছি তবে আগে থেকে করলে আমার জন্য ভালো হতো।

নিউজক্রিকেটঃ আপনাদের সময়ে সুযোগ-সুবিধা খুবই কম ছিলো। সেই সময়ের ক্রিকেটটা কেমন ছিলো?

ফাহিম মুনতাসিরঃ আমাদের সময়ের ক্রিকেটটা ছিলো বেশ কঠিন। এখনের মত এত সুযোগ-সুবিধা ছিলো না। আলাদাভাবে প্লেয়ারদের সাহায্য করার মত কোচিং স্টাফ ছিলো না। লম্বা সময় অনুশীলন করার মত সুযোগ তেমন একটা ছিলো না আমাদের সময়ে। আমার ক্যারিয়ারের শেষের দিকে সুযোগ-সুবিধা বাড়তে থাকে এবং ভালো কোচিং স্টাফও আসতে শুরু করেছিলো। কিন্তু শুরু থেকে তো আমরা ফিজিও বা ট্রেনার নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাইনি। ফিটনেস নিয়ে ভালো করে কাজ করতেও পারিনি৷ হয়তো শুরু থেকেই এসব সুবিধা-সুবিধা থাকলে আরো ভালো হতো। তারপর বড় ম্যাচে কিভাবে প্রেশার সামাল দিতে হয় এসব ব্যাপারে ধারণা কম ছিলো। আসলে এমনই ছিলো তখনকার ক্রিকেট।

নিউজক্রিকেটঃ টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতির জন্য কি করা উচিতঃ

ফাহিম মুনতাসিরঃ আমি মনে করি বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটে যতদিন না ভালো একটা অবকাঠামো আর মান হচ্ছে ততোদিন উন্নতিও হবে না। এখন দেখা যায় যে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের ম্যাচগুলো সীমিত আকারে হচ্ছে, এটা আসলে ব্যাপক আকারে হওয়া উচিত। টেস্ট ক্রিকেটে কন্ডিশন একটা বড় ব্যাপার। এ দিকটায় নজর দিতে হবে। আর ঢাকার ক্রিকেট একাডেমী আর ঢাকার বাইরের একাডেমী গুলোর মধ্যে অনেক তফাৎ। ঢাকার মত সবাই এত সুবিধা পায় না। কাজেই এই দিকগুলোতে উন্নতি করতে হবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো কোচিংয়ের মান বাড়াতে হবে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে। ভালো মানের কোচ দিলে তবেই কোয়ালিটি ক্রিকেটার বের হয়ে আসবে।

নিউজক্রিকেটঃ টেস্ট ক্রিকেট বাদ দিলে বাকি দুই ফরম্যাটে বর্তমান বাংলাদেশ দলটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ফাহিম মুনতাসিরঃ এক দিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন ভালো দল। আর টি-টোয়েন্টিতে আমাদের উন্নতির অনেক জায়গা এখনো আছে। আমাদের পাওয়ার ক্রিকেটার নেই। সবাই প্রায় এভারেজ ক্রিকেটার। টি-টোয়েন্টি পাওয়ার ক্রিকেটের খেলা সেটা সবাই জানি। মোট কথা হচ্ছে আসল জায়গাটায় এখনো আমরা যেতে পারিনি। এসব জায়গাতে উন্নতির বিকল্প নেই। আর এক দিনের ক্রিকেটে অবশ্যই বাংলাদেশ ভালো দল, বেশ ভালো করছে। বোলিংয়ের দিকটায় আরো নজর দেওয়া উচিত। ব্যাটসম্যান যদিওবা ম্যাচ জেতাবে তবে বোলারদেরও নিজেদের কাজটা সঠিকভাবে করতে হবে। এখন ক্রিকেটটা আধুনিক। এর চেয়েও বড় কথা ক্রিকেট মানুষদের আনন্দের খোরাক৷ আমরা দেখি আইসিসি ইভেন্টগুলোতে সবসময় ফ্ল্যাট উইকেটে খেলা হয়। বোলারদের জন্য অবশ্যই এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই আমি মনে করি এসব দিকে নজর দিতে হবে। বড় পর্যায়ে ভালো করতে হলে ফ্ল্যাট উইকেটে ভালো বল করার বিকল্প নেই। ম্যাচ জেতাতে পারবে এমন বোলার প্রয়োজন। এখনো আমরা এমন বোলার বের করে নিতে আসতে পেরেছি বলে আমার মনে হয়না। কাজেই এই জায়গাটায় জোর দিয়ে কাজ করতে হবে। এগুলোর উন্নতি হলেই একটা সময় বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটে শাসন করতে পারবে।

নিউজক্রিকেটঃ যেহেতু বোলারদের কথা এসেছে তাই জানতে চাইবো আমাদের দেশের পেসারদের কি সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হচ্ছে? কেবল নতুনদের কথা বলছি না। বর্তমানে যারা জাতীয় দল এবং জাতীয় দলের আশেপাশে আছেন তাদের কথা বললাম।

ফাহিম মুনতাসিরঃ বোলারদের ক্ষেত্রে সঠিক গাইডলাইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে মনে হয় ছেলেদের উন্নতির গ্রাফটা আরো ভালো হওয়া উচিত। অন্যান্য বড় দলের বোলারদের সাথে যদি তুলনা করেন তবে দেখা যাবে তাদের মত কিন্তু এখনো হতে পারে নি আমাদের বোলাররা। কিছু জায়গায় ঘাটতি আছে যেগুলোর উন্নতি দ্রুত প্রয়োজন। বিশেষ করে নতুনদের নিয়ে আরো কাজ করা উচিত। আমি যদি রাহির (আবু জাহেদ) কথা বলি ও খুব ভালো সুইং করাতে পারে। এখনকার ক্রিকেটে সুইংটাকে সবাই প্রাধান্য দেয়। ইবাদতকেও ভালো লেগেছে৷ আর মুস্তাফিজুর হচ্ছে অসাধারণ বোলার৷ এর মধ্যে বিশেষ কিছু ব্যাপার আছে। তবে ওর বড় একটা অস্ত্র ছিলো যেটা অপারেশনের পরে প্রায় হারিয়েই ফেলেছে। এটা এখন খুব কম ব্যবহার করে। এটা আমি মনে করি আরকি। এ ব্যাপারে ওর সাথে আমি কখনো কথা বলিনি। তবে আমি খুব ভালো করে এ ব্যাপারটা ফলো করি। যতদিন পর্যন্ত আউট সুইং অর্থাৎ ডান হাতি ব্যাটসম্যানদের ইন সুইং সেটা আয়ত্ত্ব করতে পারবে না ততোদিন তার সেরাটা পাওয়া যাবে না। আর এখন এক-দুইটা ম্যাচ খেলার পরেই প্রতিপক্ষ দল একজন বোলারদের মূল শক্তির জায়গাটা ধরে ফেলে। কাজেই কোয়ালিটি বোলিং দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হবে।

নিউজক্রিকেটঃ নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কমের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।

ফাহিম মুনতাসিরঃ আপনাকেও ধন্যবাদ এবং নিউজ ক্রিকেট ২৪ ডট কমের জন্য শুভকামনা।

নিউজটি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »